Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Bangladesh News

অমর একুশের শ্রদ্ধায় প্রস্তুত বাংলাদেশ

রাত ১২ টা ১ মিনিট শুরু হবে বাংলা ভাষার দিন ২১ শে ফেব্রুয়ারি। ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশের প্রথম শহিদ মিনার থেকে সেই সুদূর টেকনাফ তেতুলিয়ার শহিদ মিনারগুলোও ঢেকে যাবে ফুলে ফুলে। ওই ফুল শ্রদ্ধার, ভালোবাসার।

ভাষা দিবস উদ‌্‌যাপনে প্রস্তুত শহিদ মিনার চত্বর।

ভাষা দিবস উদ‌্‌যাপনে প্রস্তুত শহিদ মিনার চত্বর।

অঞ্জন রায়
ঢাকা শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ২২:৫৭
Share: Save:

আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা,তার পরেই বাংলাদেশ জুড়ে একটাই সুর ধ্বনিত হবে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি?’ এই অজেয় শব্দাবলীর গানটি লিখেছিলেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী। গানটিতে সুর আরোপ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের শহিদ আলতাফ মাহমুদ।

রাত ১২ টা ১ মিনিট শুরু হবে বাংলা ভাষার দিন ২১ শে ফেব্রুয়ারি। ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশের প্রথম শহিদ মিনার থেকে সেই সুদূর টেকনাফ তেতুলিয়ার শহিদ মিনারগুলোও ঢেকে যাবে ফুলে ফুলে। ওই ফুল শ্রদ্ধার, ভালোবাসার। ওই ফুলগুলোর আর কোনও নাম নেই। রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত তাদের নাম। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রথম ফুল দেবেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার পরই সকলের জন্য রাতভর খোলা থাকবে শহিদ মিনার চত্বর। শ্রদ্ধা জানানোর পর্ব চলবে সকাল সকাল ৮-৯টা পর্যন্ত।

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকেই শুরু অমর একুশের বইমেলা। শুধু ঢাকাতেই নয়, ৫৬ হাজার বর্গ মাইল জুড়ে এক দিকে যেমন বিভিন্ন এলাকায় বইমেলার আয়োজন তেমনই স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকী মফসস্‌লেও যে শহিদ মিনারগুলো আছে সেগুলোতে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দিকে হাঁটলে চোখে পড়বে পথেজুড়ে রয়েছে সুন্দর আলপনা। গত কয়েকদিন ধরে এই প্রস্তুতিতে মেতেছিল তরুণ-তরণীর দল। শহিদ মিনারের পাশের দেওয়ালে লেখা হয়েছে ১৬২০ সালে জন্ম নেওয়া বাঙালি কবি আব্দুল হাকিমের দু’টি লাইন— ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী। সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।’। এই দু’টি লাইনই যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে বাংলাভাষা, বাংলা অক্ষর কতটা আপন বাঙালির।

ফেব্রুয়ারি প্রায় শেষ। ঢাকা শহরে শীত তেমন নেই। তার পরেও প্রায় প্রতিটি ঘরেই আজ প্রস্তুতি চলছে হাতের কাছে কিছুটা শীতবস্ত্র রাখার,কারন আর একটু পরেই ২১শের প্রথম প্রহর। শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আজ সকলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসবেন। সব পথ এসে মিলবে শহিদ মিনারে। ঢাকা,চট্টগ্রাম, খুলনা,বরিশাল,রাজশাহী থেকে দূরগ্রাম সর্বত্রই ভাষা দিবসকে শ্রদ্ধা জানানোর চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। একদিকে যেমন " আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো" গান, তেমনই লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রনধ্বনি ‘জয় বাংলা’।

ফুল-আলপনায় সেজে উঠেছে শহিদ মিনারের রাস্তা।

শুধু ঢাকা বা বাংলাদেশ জুড়েই না। পৃথিবীর যেখানে বাঙালি আছেন সেখানেই আজ পালিত হবে একুশে। সিয়েরালিয়ন বা নিউইয়র্ক, লন্ডন বা মধ্যপ্রাচ্য সব জায়গাতেই অস্থায়ী শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানো হবে।

১৯৫২ সালের লড়াইটা ছিল বাংলাভাষার, বাঙালির, বাংলাদেশের। না, বাংলাদেশ তখনও বাংলাদেশ হয়ে ওঠেনি, ধর্মের দোহাই দিয়ে ভাগ করা পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ। পুরো পাকিস্তানের চুয়ান্ন শতাংশ নাগরিকই ছিলেন বাঙালি। যাঁদের মাতৃভাষা বাংলা। সেই বাংলাকে বাঙালির মুখ থেকে কেড়ে নেওয়ার আয়োজন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের। পৃথিবীর ইতিহাসে লড়াই অনেক হয়েছে। তবে ভাষার লড়াইয়ের ইতিহাস বাঙালিরই। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্যে রাস্তায় রক্ত ঢেলে দিয়ে একটি একটি করে বর্ণমালা জিতে নেওয়ার ইতিহাস একটাই। সে ইতিহাস বাঙালিদের।

সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান শুরু থেকেই বাঙালি জনগোষ্ঠীকে তার শিকড় থেকে উপড়ে দেওয়ার চেষ্টায় ছিল। একটি জাতিগোষ্ঠীর কাছে তার ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের দুটি অংশ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে ভাষা, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক কোন মিল ছিল না।

আরও পড়ুন: বসন্তবরণ উত্সবে মেতে উঠেছে ঢাকা

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বাংলা ভাষায় পূর্ব বাংলার ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলতেন। এবং ভাষা হিসেবে পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি মানুষ বাংলা ভাষাতেই কথা বলতেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের করাচিতে জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা এবং স্কুল ও মিডিয়ায় ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়।

শুরু হয় প্রতিবাদ। কিন্তু তার মধ্যেই পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন অনুমোদিত বিষয় তালিকা, মুদ্রার নোট থেকে বাংলাকে মুছে ফেলে তৎকালীন পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার বিস্তর প্রস্তুতি নেন। চলতে থাকে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। যে প্রতিরোধের চূড়ান্ত রূপটিই ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। রফিক-সালাম-জব্বার-বরকতের জীবনের বিনিময়ে বাঙালি প্রতিষ্ঠা করেছিল তার মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার।

পথজুড়ে আঁকা হয়েছে সুন্দর আলপনা।

১৯৯৮ কানাডায় বসবাসকারী দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন সেই সময়ের রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব কোফি আন্নানের কাছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে ইউনেস্কোর অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি সদস্যদেশগুলোতেও পালিত হতে শুরু করে।

আরও পড়ুন: খালেদার সেলে টিভি-এসি, বাইরে এরশাদের কুলগাছ

এর পর ২০১০ সালে রাষ্টপুঞ্জের ৬৫তম অধিবেশনে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করার প্রস্তাবটি উত্থাপন করে বাংলাদেশ। এটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।

এখন অমর একুশে আর শুধু বাংলাদেশ বা বাঙালির না, বিশ্বের প্রতিটি দেশে পালিত হওয়া একটি দিন। যা বাঙালির গর্বের। যে গর্ব থাকবে হাজার বছর।

ছবি: আসাদ আহমেদ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE