২১ শে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের একটি মুহূর্ত।
বাহান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালির জাতীয় জীবনে এক মর্মন্তুদ অথচ গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বিশ্বের ইতিহাসে ভাষার জন্য অকাতরে জীবন দেওয়ার দৃষ্টান্ত একমাত্র বাঙালিই স্থাপন করতে পেরেছে। বাঙালির সেই আত্মগরিমার স্বীকৃতি আজ দুনিয়াজুড়ে।
সেদিন যা ঘটেছিল—
১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যাবেলায় সরকারি ঘোষণা আসে পর দিন অর্থাত্ ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এ দিকে আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বালার দাবিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হরতাল।
২১ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৮টা
পাকিস্তান সরকারের ১৪৪ ধারার পরোয়া না করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট মিছিল নিয়ে সমবেত হতে থাকেন কলা ভবনের সামনে। প্রথমে পুলিশ বাধা দেয়নি। বাড়তেই থাকে সমাবেশ। ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা দশ হাজার অতিক্রম করে।
গাজীউল হকের সভাপতিত্বে শুরু হয় প্রতিবাদ সভা। সভা চলার সময়েই খবর আসে ঢাকার লালবাগে স্কুল পড়ুয়াদের মিছিলের উপর পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে লাঠি চার্জ করেছে। উত্তেজনা বাড়তে থাকে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মতিন এবং সভাপতি গাজীউল হক উভয়েই ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বক্তৃতা দেন। স্লোগান ওঠে ‘১৪৪ ধারা মানি না, মানব না’।
আরও পড়ুন: অমর একুশের শ্রদ্ধায় প্রস্তুত বাংলাদেশ
সকাল ৯টা
ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্যদের ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতামতকে বিবেচনা করার আহ্বান জানান। এই সময়ে সকাল ৯টায় অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের সদস্যদের সভাস্থল ঘিরে রাখে পুলিশ।
সকাল ১১টা
১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্ররা রাস্তায় মিছিলে নামতে গেলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। এ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পুলিশকে কাঁদনে গ্যাসের ব্যবহার বন্ধ করতে অনুরোধ জানান। কয়েক জনকে ১৪৪ ধারা ভাঙার অভিযোগে গ্রেফতার করে পুলিশ। ছাত্রদের গ্রেফতারের পরই ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহের আগুন।
দুপুর ২টো-৩টে
দুপুর ২টোয় পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। ছাত্ররা প্রথমে আইন পরিষদের সদস্যদের আইনসভায় যোগ দিতে বাধা দিলেও পরে সিদ্ধান্ত নেন আইনসভায় গিয়ে তাঁদের দাবি জানাবেন। ৩টের সময় ছাত্ররা আইনসভার দিকে এগোতে গেলে পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে আব্দুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এছাড়া অহিউল্লাহ নামের এক বছরের কিশোর-সহ নিহত হন আব্দুস সালাম, আবুল বরকতসহ আরও অনেকে।
২১ ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণে শহিদ হওয়া ৪ জনের মধ্যে তিনজন ছিলেন ছাত্র। এরা হলেন আবুল বরকত, জব্বার ও রফিক উদ্দিন। অন্য জন শহিদ সালাম। যিনি বাদামতলীর একটি প্রেসের কর্মচারী ছিলেন। ওই দিন রাস্তায় পড়ে থাকা আরও কিছু দেহ পুলিশ দ্রুত ট্রাকে করে তুলে নিয়ে যায়। যাঁদের পরিচয় আর জানা যায়নি।
পুরোনো ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে ইডেন কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রীরা। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩
এ দিকে ছাত্রদের হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে জনগণ ঘটনাস্থলে আসার উদ্যোগ নেয়। কিছু ক্ষণের মধ্যেই সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রদের আন্দোলন জনমানুষের আন্দোলনে রূপ নেয়। দ্রুত ভূমিকা নেন সাংস্কৃতিক জগতের লোকজনও। রেডিও শিল্পীরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে শিল্পী ধর্মঘট আহ্বান করেন এবং রেডিও স্টেশন পূর্বে রেকর্ড করা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে থাকে।
আরও পড়ুন: বসন্তবরণ উত্সবে মেতে উঠেছে ঢাকা
ভাষা শহিদদের স্মৃতিকে স্মরণে রাখতে ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যা পাকিস্তান সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি গুঁড়িয়ে দেয়। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও গতি পায়। এর পর ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৯ মে গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।
সমস্ত ছবি আর্কাইভ থেকে
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy