Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

এসইজেড তকমায় না, উল্টে ক্ষতিপূরণ দাবি

ইনফোসিসের প্রকল্প হিমঘরে চলে গিয়েছে আগেই। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের অনড় অবস্থানের জেরে এ বার ঘোর অনিশ্চয়তার মুখে উইপ্রোর প্রস্তাবিত দ্বিতীয় ক্যাম্পাস। এ ক্ষেত্রে আবার উইপ্রোর কাছেই প্রকল্পে দেরির জন্য জরিমানা-সহ জমির বকেয়া দাম চেয়ে বসেছে হিডকো। পাল্টা চিঠিতে উইপ্রো সবিস্তার জানিয়েছে, রাজারহাটে দ্বিতীয় ক্যাম্পাস গড়তে গিয়ে কী ভাবে পদে পদে বাধার মুখে পড়েছে তারা।

গার্গী গুহঠাকুরতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:১২
Share: Save:

ইনফোসিসের প্রকল্প হিমঘরে চলে গিয়েছে আগেই। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের অনড় অবস্থানের জেরে এ বার ঘোর অনিশ্চয়তার মুখে উইপ্রোর প্রস্তাবিত দ্বিতীয় ক্যাম্পাস। এ ক্ষেত্রে আবার উইপ্রোর কাছেই প্রকল্পে দেরির জন্য জরিমানা-সহ জমির বকেয়া দাম চেয়ে বসেছে হিডকো। পাল্টা চিঠিতে উইপ্রো সবিস্তার জানিয়েছে, রাজারহাটে দ্বিতীয় ক্যাম্পাস গড়তে গিয়ে কী ভাবে পদে পদে বাধার মুখে পড়েছে তারা।

ক্ষমতায় আসার পরেই মমতা জানিয়েছিলেন, নীতিগত ভাবে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা এসইজেড-এর বিরোধী তাঁর দল। এসইজেড তকমা ছাড়া ব্যবসা করা লাভজনক নয়— এই যুক্তিতে রাজ্যে তাদের ১০০০ কোটিরও বেশি লগ্নি-প্রস্তাব স্থগিত রেখেছে ইনফোসিস। সেই অবস্থানের যে কোনও পরিবর্তন হয়নি, সংস্থার তরফে সম্প্রতি আনন্দবাজারকে পাঠানো একটি ই-মেল উত্তরেই তা স্পষ্ট। ইনফোসিস জানিয়েছে, এ রাজ্যে ক্যাম্পাস তৈরি নিয়ে তাদের নতুন কোনও ভাবনাচিন্তা নেই। হিডকোকে দেওয়া চিঠিতে উইপ্রোও জানিয়ে দিয়েছে, এসইজেড তকমা ছাড়া ব্যবসায় লাভ করা কঠিন।

দীর্ঘ টানাপড়েনের পরে উইপ্রোর দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের জন্য ৫০ একর জমি বরাদ্দ করতে পেরেছিল বাম সরকার। ২০০৯-এর ডিসেম্বর মাসের গোড়ায় রাজারহাটে দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের জমি দেখে গিয়েছিলেন উইপ্রোর কর্ণধার আজিম প্রেমজি। তখনই তিনি জানিয়েছিলেন, ১৮ মাসের মধ্যে প্রকল্প তৈরির কাজ শুরু হবে।

২০১০-এ বছরের প্রথম দিনেই জমির দাম বাবদ প্রথম কিস্তির চেক জমা দেয় উইপ্রো। চেকের অঙ্ক ১৮ কোটি ৯০ লক্ষ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা। একর প্রতি দেড় কোটি টাকা দরে ৫০ একর জমি তাদের লিজে দেয় রাজ্য সরকার। জমির বাকি দাম ছাড়াও হিডকোকে প্রতি বছর পরিষেবা কর-সহ অন্যান্য খাতে টাকা দেওয়ার কথা উইপ্রোর। নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১১ সালের জুন মাস নাগাদ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। উইপ্রো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাঁদের প্রকল্পের জমিতে চাষ করা হয়েছিল। সেই ফসল না ওঠা পর্যন্ত তাঁরা কাজেই হাত দিতে পারেননি। তা ছাড়া, জমির মধ্যে দিয়ে খাল ছিল। খাল ভরাটের কাজেও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে গড়িমসির অভিযোগ রয়েছে উইপ্রোর চিঠিতে। সেই সঙ্গে আছে এসইজেড-জটের প্রসঙ্গ।

এই পরিস্থিতিতে ইনফোসিসের মতো খোলাখুলি না জানালেও দ্বিতীয় ক্যাম্পাস তৈরির পরিকল্পনা হিমঘরে ঠেলছে উইপ্রোও। প্রস্তাবিত দ্বিতীয় ক্যাম্পাসে প্রায় ১০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ ও ২০ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হওয়ার কথা ছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, উইপ্রো কর্তা আজিম প্রেমজি কলকাতায় নিজের কর্মীদের জানিয়েছেন, সম্প্রসারণ বর্তমান ক্যাম্পাসেই হবে। জায়গা সংক্রান্ত সমস্যা মেটাতে সেখানেই নতুন ‘টাওয়ার’ বা বহুতল তৈরি করা হবে। সে জন্য ক্যাম্পাসের খোলামেলা পরিবেশের সঙ্গে সমঝোতা করতে হলেও উপায় নেই। কারণ, এই ক্যাম্পাস থেকে ব্যবসার পরিমাণ লাফিয়ে বাড়ছে। প্রসঙ্গত, উইপ্রোর এই ক্যাম্পাস সারা দেশের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত প্রথম বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল।

উইপ্রোর চিঠি নিয়ে হিডকোর চেয়ারম্যান দেবাশিস সেনের বক্তব্য জানার জন্য বহু বার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও জবাব দেননি। তবে হিডকোর সঙ্গে উইপ্রোর এই চাপানউতোরের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারের তৈরি বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি কমিটির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

২০১১ সালে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই তৈরি হয় তারকাখচিত তথ্যপ্রযুক্তি কমিটি। কমিটির চিফ মেন্টর করা হয় ইনফোসিসের প্রাণপুরুষ এন আর নারায়ণমূর্তি-কে। কমিটির অন্যতম প্রধান হন স্যাম পিত্রোদা। রয়েছেন ন্যাসকমের প্রাক্তন প্রধান কিরণ কার্নিক। এ ছাড়াও কমিটির সদস্য তালিকায় প্রাইসওয়াটার হাউজ কুপার্স, ডেলয়েট, টিসিএস, উইপ্রো, কগনিজেন্ট টেকনোলজি-সহ বিভিন্ন প্রথম সারির তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার প্রতিনিধিরা রয়েছেন। মূলত এই তথ্যপ্রযুক্তি কমিটির সদস্যদের পরামর্শ মেনেই নয়া তথ্যপ্রযুক্তি নীতি তৈরি করে রাজ্য।

তবে ওই পর্যন্তই। সেই নীতি বাস্তবে কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে, তা নিয়ে কোনও আলোচনায় বসেনি কমিটি। পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী থাকার সময়ে তা-ও কমিটির দু’টি বৈঠক হয়েছিল। বর্তমান শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্রের আমলে একটিও হয়নি। অথচ মুখ্যমন্ত্রীর সিঙ্গাপুর সফরের পরে ফের ঘটা করে আরও একটি তথ্যপ্রযুক্তি কমিটি গঠনের কথা ঘোষণা করেছেন অমিতবাবু। নতুন পাঁচ সদস্যের কমিটিতেও রয়েছেন টিসিএস, কগনিজেন্ট, ন্যাসকম ও সোনোডাইনের প্রতিনিধি। রাজ্য সরকারের তরফে রয়েছেন তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পসচিব সতীশ তিওয়ারি।

২০১১ সালে তথ্যপ্রযুক্তি কমিটি তৈরির সময় রাজ্য সরকার দাবি করেছিল, নারায়ণমূর্তির মতো আন্তর্জাতিক নাম জুড়লে রাজ্যের ‘ব্র্যান্ডিং’-এর কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। এই যুক্তিতে সায় দিয়েছিল তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পমহলও। কিন্তু ইনফোসিসের পরে উইপ্রোর প্রকল্প নিয়েও একই রকম জটের পরে প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্যের শিল্পবিরূপ ভাবমূর্তির ভূত তাড়াতে আগের কমিটিকেই ঠিক মতো ব্যবহার করা হয়েছিল কি? যদি না হয়, তা হলে নতুন কমিটি তৈরি করেই বা কী লাভ?

বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধুমাত্র শিল্পমহলের প্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটি তৈরি করলেই কাজ শেষ হয় না। এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্তার ব্যাখ্যা, যে সমস্ত বিষয়ে মতামত আদান-প্রদানের কথা মাথায় রেখে কর্পোরেট মহলকে শরিক করা হচ্ছে, তার সঠিক প্রয়োগ না হলে গোটা বিষয়টাই ‘লোক দেখানো’ হয়ে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে তিনি তুলে আনেন সেই এসইজেড-জটের কথাই। ইনফোসিস ও উইপ্রোর প্রকল্প নিয়ে ওই কমিটির থেকে কোনও পরামর্শ চায়নি রাজ্য। এক সদস্যের বক্তব্য, “পরামর্শ দিলেই তা মানতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। কিন্তু আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সূত্র বেরিয়েও আসতে পারত।”

মজার কথা, পুরোনো কমিটির সদস্যরা সঠিক ভাবে জানেন না, সেই কমিটির অস্তিত্ব আদৌ আছে কি না। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, সরকারি ভাবে ওই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়নি। তবে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের রথী-মহারথীদের নিয়ে তৈরি কমিটিরই যদি এই হাল হয়, তবে নতুন কমিটির দশা কী হবে, তা নিয়ে সংশয় কাটছে না কর্পোরেট মহলের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

special economic zones wipro gargi guhathakurata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE