অমিত মিত্র
রাজ্যে শ্রমিক সংগঠনে রাজনৈতিক কব্জা পোক্ত করতে গিয়ে আলগা হয়েছে শিল্পের পায়ের তলার মাটি। ক্রমাগত ভুল বার্তা গিয়েছে শিল্পমহলে। তাই এ বার সেই ধারণা বদলের লক্ষ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বন্ধ কারখানার মালিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে শুরু করল রাজ্য। চলতি সপ্তাহেই বৈঠকের জন্য ডাক পড়েছে ডানলপ, হিন্দ মোটরস, জেসপ, শালিমার পেন্টস, ডাকব্যাকের মতো সংস্থার।
রাজ্য চাইছে একেবারে খোলা মনে ওই সমস্ত বন্ধ কারখানার সমস্যা বুঝতে। সব সময়ে শুধু মালিকদেরই দোষী না-করে শুনতে চাইছে তাঁদের ক্ষোভ-অভাবের কথা। ঠিক হয়েছে, এ জন্য প্রথমে শ্রমমন্ত্রী এবং পরে শিল্পমন্ত্রী বৈঠকে বসবেন বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে।
এ প্রসঙ্গে শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক বলেন, “মালিকদেরও ক্ষোভ থাকে। তা জানার এবং আরও ভাল ভাবে বোঝার চেষ্টা করব। আমরা মালিক-বিরোধী নই। তাঁদের যুক্তি, সুবিধা-অসুবিধা আমরা শুনতে চাই। বন্ধ কারখানা খুলতে রাজ্য কী কী ভাবে সাহায্য করতে পারে, তাঁরা তা বলুন। এ সব জানতেই এই বৈঠক।”
রাজ্যের শিল্পমহলের একটা বড় অংশ মনে করে, মুখ্যমন্ত্রী প্রায়ই শ্রমদিবস নষ্ট না-হওয়ার কথা বলেন। কিন্তু জমি জট এবং অন্যান্য পরিকাঠামোগত অসুবিধার পাশাপাশি রাজ্যে শিল্পায়নে বড় কাঁটা কারখানায় ‘ঝান্ডাবাজি’। এক শিল্পকর্তার কথায়, আগের মতো ইউনিয়নের ছত্রচ্ছায়ায় কারখানায় দিনের পর দিন ধর্মঘট বা রক্তক্ষয়ী আন্দোলন হয়তো এখন তেমন ঘটে না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যা পাকায় শাসক দলের মদতপুষ্ট বহিরাগতরা। কখনও তারা শ্রমিকদের ভুল বুঝিয়ে তাতিয়ে তোলে (জলজ্যান্ত উদাহরণ নর্থব্রুক জুটমিলের ঘটনা), তো কখনও আবার প্রভাব খাটায় তোলা আদায়ের জন্য। শিল্পমহলের একাংশের মতে, রাজ্য সরকার যদি সব সময়েই শ্রমিকদের আড়াল করে সব দোষ মালিকপক্ষের ঘাড়ে চাপায়, তাতে আস্কারা পায় এই বহিরাগতরা। তাই এ বার সরকার কথা শোনার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায়, কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করছেন তাঁরা।
মলয় ঘটক
নবান্ন সূত্রে খবর, নতুন বিনিয়োগ আনতে মুখ্যমন্ত্রী সিঙ্গাপুর পাড়ি দিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি চান, রাজ্যে একের পর এক বন্ধ হওয়া কারখানার দরজাও খুলুক। কারখানা বন্ধের জন্য সব সময়ে শুধু মালিকপক্ষই দায়ী, এমন ধারণা সরিয়ে বরং খোলা মনে আলোচনার টেবিলে বসা হোক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। সরকারি সূত্রে খবর, বিদেশ সফরে যাওয়ার আগে এ নিয়ে মমতা নিজে কথা বলেছেন শ্রমমন্ত্রীর সঙ্গে। আর তারপরই চলতি সপ্তাহে আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বিভিন্ন বড়-মাঝারি বন্ধ কারখানার পরিচালন কর্তৃপক্ষকে।
কারখানা বন্ধের দায় সব সময়ে শুধু কর্তৃপক্ষের উপর চাপানোর প্রবণতা যে সমস্যা সৃষ্টি করছিল, তা মানছেন তৃণমূলের অন্দরের লোকেরাও। শ্রম দফতর সূত্রেই খবর, পূর্ণেন্দু বসু শ্রমমন্ত্রী থাকাকালীন শাসক দলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র রাশ ছিল দোলা সেনের হাতে। সংগঠনকে জনপ্রিয় করতে শ্রমিকদের ত্রুটি-বিচ্যুতি আড়াল করার নীতিও নেওয়া হয়ল। কিন্তু এতে সংগঠনে দোলাদেবী-সহ কিছু নেতা-নেত্রীর দাপট বাড়লেও শিল্পে রাজ্য ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে বলে জানানো হয় মুখ্যমন্ত্রীকে। তারপরই এই পদক্ষেপ।
সম্প্রতি দোলাদেবীর ‘রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী’ মলয়বাবুর হাতে শ্রম দফতরের দায়িত্ব দিয়ে দলনেত্রী মমতা বুঝিয়েও দিয়েছেন, দফতরের দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল চান তিনি। শ্রমিক সংগঠনে দোলাদেবীর বিরোধী বলে পরিচিত শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ও সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, সব বিষয়ে মালিকপক্ষের উপর দোষ চাপানোর প্রবণতার কারণে আখেরে নষ্ট হচ্ছে শিল্পের পরিবেশই।
বৈঠক নিয়ে কতটা আশাবাদী শিল্প?
বেঙ্গল ওয়াটারপ্রুফের (ডাকব্যাক) প্রধান অভিষেক বসু বলেন, “আগে কখনও আমাদের ডাকা হয়নি। আর্থিক অনটন ও তার জন্য কর্মী বিক্ষোভে ২০১৩-র অক্টোবর থেকে কারখানা বন্ধ। ডাক পেয়ে তাই আমরা উত্সাহিত।”
ডানলপ কর্তৃপক্ষের তরফে ধ্রুবজ্যোতি নন্দী বলেন, “এই পদক্ষেপ স্বাগত।” বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের ডিরেক্টর জেনারেল পি রায় মনে করেন, “একের পর এক কারখানা বন্ধ হওয়ায় রাজ্যের ভাবমূর্তি তলানিতে। এই চেষ্টা সম্ভবত সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতেই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy