Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সুদ ছাঁটাইয়ে পৌষ মাস শিল্পের

সঞ্চয় করা চাই সুদ আরও কমার আগে

সুদ, সুখ ও শান্তি এই তিনটি শব্দ আকারে বেশ ছোট হলেও মানুষের জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সুদের সঙ্গে সুখ ও শান্তির সম্পর্ক যেন বিপরীতমুখী। সুদ বাড়লে কিছু মানুষের সুখ বাড়ে, কিন্তু অন্যদের শান্তি বিঘ্নিত হয়।

অমিতাভ গুহ সরকার
শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৫ ০১:৩৯
Share: Save:

সুদ, সুখ ও শান্তি এই তিনটি শব্দ আকারে বেশ ছোট হলেও মানুষের জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সুদের সঙ্গে সুখ ও শান্তির সম্পর্ক যেন বিপরীতমুখী। সুদ বাড়লে কিছু মানুষের সুখ বাড়ে, কিন্তু অন্যদের শান্তি বিঘ্নিত হয়। ঠিক উল্টোটা হয় সুদ কমলে। যেমনটা হয়েছে গত সপ্তাহে। অপ্রত্যাশিত ভাবে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ৫০ বেসিস পয়েন্ট সুদ কমানোয় শিল্প, বাণিজ্য ও শেয়ার বাজার খুশি হলেও তা এক রকম রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে সুদ-নির্ভর অসংখ্য মানুষের।

জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর এই ন’মাসে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রেপো রেট কমিয়েছে চার বার। সুদ নেমেছে ১২৫ বেসিস পয়েন্ট। সুদ কমানোর জন্য শিল্প-বাণিজ্য, শেয়ার বাজার, এমনকী কেন্দ্রেরও প্রবল চাপ ছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উপর। বেশ কিছু দিন আটকে রাখার পরে এ বার রঘুরাম রাজনকে হাঁটতেই হল সুদ কমানোর পথে। তবে এক দফায় ৫০ বেসিস পয়েন্ট সুদ ছাঁটাই অবশ্যই প্রত্যাশিত ছিল না। তা এক লাফে এতটা নেমে আসায় বেশ মুষড়ে পড়েছেন চড়া বাজার দরের ভারে নুয়ে পড়া সুদ-নির্ভর এক বিরাট জনতা। ছোট পরিসরে এ বার বিশ্লেষণ করে দেখা যাক এর প্রভাব কার উপর কতটা পড়ল। কার সুখ বাড়ল এবং কারই বা শান্তি নষ্ট হল।

শিল্প: শিল্প সব সময়েই চায় সুদ কমুক। তা হলে মূলধন সংগ্রহের খরচ কমে। ফলে কম হয় উৎপাদন খরচ এবং কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় উৎপাদিত পণ্যের দাম। দাম কম হলে পণ্যের চাহিদা বাড়ে। ফলে বিক্রি বাড়ে ও কিছুটা বাড়ে মুনাফাও। অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় এটি হল অর্থনীতির তত্ত্বকথা। বাস্তবে এটা কতটা ফলে, তার উপর প্রশ্নচিহ্ন থেকেই যায়। যেমন, এতটা সুদের হার কমায় আগামী দিনে কি পণ্যমূল্য কমবে? সেটা বোঝা যাবে আগামী কয়েক সপ্তাহেই। একটি বড় মাপের সংস্থার তরফে বলা হয়েছে, তাদের সাশ্রয় হতে পারে ১০০ কোটি টাকা। এর কতটা দাম কমার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের উপর বর্তায়, সেটাই এখন দেখার।

ব্যাঙ্ক: সুদ কমলে ঋণের চাহিদা বাড়ে। ফলে ব্যবসা বাড়ে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের। শিল্পের খরচ কমে। নতুন শিল্প স্থাপন সহজ হয়। কিন্তু ঋণে সুদ কমলে তা কমাতে হয় জমার উপরেও।

সরকার: বেশ কিছু দিন থেকেই কেন্দ্র চাইছিল সুদ কমুক। এতে উৎপাদন খরচ কমে। ফলে দাম কমার হাত ধরে বাড়ে চাহিদা, যা আরও উৎপাদন বাড়ানোয় ইন্ধন জোগায়। বাড়ে কর্মসংস্থান। গড়ে ওঠে নতুন শিল্প। বাড়ে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড। সব মিলিয়ে জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি আরও বেশি হারে বাড়ে। পাশাপাশি কোম্পানিগুলি ভাল ফল প্রকাশ করলে তা দেশ-বিদেশ থেকে লগ্নি আকর্ষণ করে। বিদেশি লগ্নি বাড়লে বিদেশি মুদ্রাভাণ্ডার স্ফীত হয়। নিয়ন্ত্রণে থাকে ডলারের দাম। ফলে সরকারের আমদানি খরচ কমে। খরচ কমে আমদানি-নির্ভর শিল্পের। তাই শিল্পোন্নয়ন এবং বিদেশি লগ্নি টানার জন্য সুদ হ্রাসের যৌক্তিকতা আছে।

পণ্যমূল্য: সুদ কমলে শিল্পে তৈরি জিনিসের দাম কমার কথা। বাস্তবে কতটা হয়, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন থেকেই যায়। অন্য দিকে ঋণে সুদ কমলে বাজারে টাকার জোগান বাড়ে এবং জমার উপর সুদ কমলে মানুষ টাকা জমানোর থেকে খরচ করাকে প্রাধান্য দেয়। সব মিলিয়ে পণ্যের চাহিদা বাড়ে। ফলে দামও বাড়ে। অর্থাৎ শিল্পোৎপাদন বাড়লে, কর্মসংস্থান বাড়লে এবং টাকার জোগান বাড়লে দাম বাড়ার প্রবণতাও দেখা দেয়। যার মানে, আর্থিক বৃদ্ধির সঙ্গে কিছুটা মূল্যবৃদ্ধিকেও সহ্য করে নিতে হয়। অর্থনীতির দুর্দিনে পণ্যের চাহিদা কমে। ফলে দাম ও সুদও নিম্নগামী হয়। আমাদের দেশে অবশ্য অর্থনীতির ফর্মুলায় সব কাজ হয় না। বাজারে কালো টাকার জোগান এত বেশি যে, সুদ বাড়িয়ে বা কমিয়ে টাকার মোট জোগানকে নিয়ন্ত্রণ করা বেশ শক্ত কাজ। অর্থাৎ সুদ কমলে জিনিসের দাম কমবে, এমনটা ধরে নেওয়া যায় না।

শেয়ার বাজার: দুই সূচকের পুনরুত্থান দেখে বোঝাই যায়, বাজার বেশ খুশি। সুদ কমায় কোম্পানিগুলির যদি খরচ কমে এবং লাভ বাড়ে, তবে তা বাজারকে শক্তি জোগাবে। আরও বেশি করে বিদেশি লগ্নি আকর্ষণ করবে। পাশাপাশি অবশ্য আছে মার্কিন মুলুকে সুদ বাড়ার আশঙ্কা এবং বিশ্ব অর্থনীতির নানা সমস্যা। কয়েকটি রাজ্যে কম বৃষ্টিও ভোগাবে ভারতীয় অর্থনীতিকে। অর্থাৎ নিম্নগামী সুদ একক ভাবে বাজারকে ঊর্ধ্বগামী রাখবে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। ব্যাঙ্ক এবং অন্যত্র জমার উপর সুদ কমলে অবশ্য লগ্নির কিছুটা শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ডে প্রবাহিত হবে।

আমজনতা: সুদ বাড়া-কমার এক বিরাট প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের উপর। বিশেষ করে পিরামিডের একদম নীচের সারির মানুষের উপর। সুদ কমলে যতটা না নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমে, তার থেকে বেশি কমে তাঁদের সুদ বাবদ আয়। এর আগেও তিন দফায় ৭৫ বেসিস পয়েন্ট সুদ কমেছে। সরকারি পরিসংখ্যান যা-ই বলুক, রোজকার বাজারে কি দাম কমছে? খাতায়-কলমে মূল্যবৃদ্ধি কমেছে, কারণ অশোধিত তেলের দাম পড়েছে। বাড়েনি ইস্পাত-সিমেন্ট ইত্যাদির দাম। কিন্তু এতে সাধারণ মানুষ কতটা উপকৃত হয়েছেন? যাঁরা বাড়ি, গাড়ি কেনার জন্য ঋণ নিয়েছেন, সুদ কমায় কিছুটা উপকৃত হয়েছেন তাঁরা। কমেছে তাঁদের ইএমআই। প্রশ্ন হল, মোট জনতার এঁরা কত শতাংশ। বাড়ি-গাড়ি ঋণে সুদ কমলে অবশ্য ওই দুই শিল্পে চাহিদা বাড়ে। উপকৃত হয় আরও অনেক শিল্প যেমন ইস্পাত, সিমেন্ট, রং, টায়ার, যন্ত্রাংশ, প্লাস্টিক, ইলেক্ট্রনিক ইত্যাদি। ফলে এই সব শিল্পে বাড়ে কর্মসংস্থান। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সুদ কমার কিছুটা যৌক্তিকতা আছে।

প্রবীণ নাগরিক: সুদ হ্রাসে সব থেকে বেশি আঘাত পৌঁছেছে অবসরপ্রাপ্ত ও প্রবীণ নাগরিকদের ঘরে। ভাল রকম কমেছে তাঁদের সুদ বাবদ আয়। অন্য দিকে চিকিৎসা ও ওষুধের দাম কি কমেছে? যাঁরা আগে বেশি সুদে টাকা রেখেছেন, তাঁরা মেয়াদ শেষে ওই টাকা নতুন করে জমা বা রিনিউ করলে তাঁদের আয় অনেকটাই কমে যাবে। যাঁরা সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন বা নেবেন, তাঁদের নতুন করে জীবনযাত্রার খরচের অঙ্ক কষতে হবে। গত ৯ মাসে ব্যাঙ্কে সুদ কমেছে কম-বেশি ১.২৫%। যে-ব্যক্তি অবসর বাবদ ৩০ লক্ষ টাকা পেয়েছেন ও আগের সঞ্চয় সমেত মোট ৫০ লক্ষ টাকা জমা রেখেছিলেন, এখন সুদ কমার কারণে তাঁর মাসিক আয় কমতে পারে কম-বেশি ৫,২০০ টাকা। শোনা যাচ্ছে, ডাকঘরেও সরকার সুদ কমানোর কথা ভাবছে। প্রবীণ নাগরিক প্রকল্পে এখনও ৯.৩% সুদ দেওয়া হচ্ছে, যা এই বাজারে বেশ আকর্ষণীয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গত সপ্তাহে সুদ কমানোয় বেশির ভাগ ব্যাঙ্ক সম্ভবত এ সপ্তাহেই জমায় সুদ কমানোর সিদ্ধান্ত নেবে। সুদের হার কমানো হতে পারে পিপিএফ অ্যাকাউন্টেও। অর্থাৎ লগ্নি করতে হবে সুদ কমার আগেই।

বন্ড: সুদ কমায় বাজারে আগে ইস্যু করা বন্ডের দাম বেড়েছে। ফলে বেড়েছে বন্ড ফান্ড এবং ঋণপত্র-নির্ভর ফান্ডের ন্যাভ। তবে বাজারে যে-সব নতুন বন্ড আসবে, তাতে সুদের হার কিছুটা কমবে। পিএফসি-র পরে করমুক্ত বন্ড ইস্যুতেও সুদ কমবে বলে ধরে নেওয়া যায়।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সুদ কমার প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলাদা। সাধারণ মানুষও চান, জিডিপি আরও বেশি হারে বাড়ুক। শিল্প-ব্যবসায় লাভ হোক। তবে সমাজের উপর দিকের ভাল করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ যেন বিপাকে না-পড়েন। বর্ধিত জাতীয় আয়ের বড় অংশ যেন বেশি আয়ের মানুষের হাতে আটকে না-থাকে। সাধারণ মানুষের আয় না-বাড়লে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না, তা জিডিপি যতই বেশি হারে বাড়ুক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE