প্রায় একমাস আগে নোট বাতিলের ঘোষণায় গোটা দেশে যে-কম্পন অনুভূত হয়েছিল, তা এখনও মিলিয়ে যায়নি। বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে নতুন করে তা প্রকট হয়ে উঠছে। ধনী-দরিদ্র, নবীন-প্রবীণ কেউ এই সমস্যা থেকে রেহাই পাননি। এই ‘আফটার শক’ যে-আরও বেশ কিছু দিন চলবে, তা এখন সরকারি মহল থেকেও বলা হচ্ছে। আর, তার ছাপই পড়ছে শেয়ার বাজারে। এই সপ্তাহেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তার ঋণনীতি ফিরে দেখতে বসে সুদ ফের কমালে আরও বিপাকে পড়বেন সুদ নির্ভর আয়ের উপর নির্ভরশীল অসংখ্য মানুষ।
বাতিল নোট জমার তুলনায় যে- পরিমাণ নতুন নোট বাজারে ছাড়া হচ্ছে, তার সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এর একটি বড় অংশ ২০০০ টাকার নোট, যার হস্তান্তরযোগ্যতা বেশ কম। এ ছাড়া দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে যাঁরা ছোট নোট পাচ্ছেন, তাঁরা কিন্তু সহজে তা হাতছাড়া করতে চাইছেন না। ব্যবহার করছেন শুধু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পণ্য ও পরিষেবা ক্রয়ের জন্য। ফলে ভাল রকম চাহিদা কমেছে অন্য সব পণ্যের। সরকার চেষ্টা করছে মানুষকে কার্ড ও অনলাইন লেনদেনে উদ্বুদ্ধ করতে। এটা কিন্তু রাতারাতি ঘটবে না। নগদহীন লেনদেনে অভ্যস্ত হতে মানুষের অনেক সময় চাই। তবে পরিস্থিতির চাপে এই পরিবর্তন খানিকটা দ্রুত হবে। পণ্যের চাহিদা কমায় বিক্রি কমেছে বহু সংস্থার। এর প্রতিফলন পড়বে ওই সব সংস্থার লাভের উপরেও। বিক্রি বাড়াতে অনেকেই লোভনীয় ছাড় দিচ্ছে। নগদ-নির্ভর বাজারে ক্রেতার আনাগোনা বেশ কম। ঝাঁপ নামিয়ে রেখেছেন অনেক বিক্রেতা।
চাহিদা, বিক্রি ও উৎপাদন কমায় জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি-র বৃদ্ধির উপর যে বড় ধাক্কা পৌঁছবে, তা এখন অনেকটাই স্পষ্ট। নোট বাতিলের আগের তিন মাসেই (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এই বৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৭.৩%, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় (৭.৬%) কম। আশঙ্কা, বছরের শেষ ছ’মাসে তা আরও নেমে আসবে। এরই মধ্যে মূল্যায়ন সংস্থা ‘ফিচ’ ভারতের সম্ভাব্য বৃদ্ধির হার ৭.৪% থেকে কমিয়ে এনেছে ৬.৯ শতাংশে। আগের দু’বছর কৃষিতে খরা ভারতকে ভুগিয়েছে। কৃষি আশা দিলেও এ বার ভোগাচ্ছে টাকার খরা। আর, এরই প্রতিফলন পড়ছে শেয়ার বাজারে।
নোট ছাড়া আর যে-সব কারণ বাজারকে শঙ্কায় রেখেছে, সেগুলি হল:
• মার্কিন শীর্ষ ব্যাঙ্ক ফেডারেল রিজার্ভের সুদ বাড়ানোর প্রবল সম্ভাবনা
• ব্রিটেনের পথে হেঁটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপারে ইতালিরও গণভোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত
এই সব কারণে বাজার অনেকটাই নেমেছে শুক্রবার। শেয়ার বিক্রি করেই চলেছে বিভিন্ন বিদেশি লগ্নিকারী সংস্থা। দেশি অর্থসংস্থা এবং মিউচুয়াল ফান্ড শেয়ার কিনলেও তা পতন ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট নয়। আগামী মার্চে সেনসেক্স ৩০/৩২ হাজারে পৌঁছবে বলে যাঁরা আগাম অনুমান করেছিলেন, পরিস্থিতির বিচারে তাঁরা এখন ‘সেনসেক্স টার্গেট’ কমিয়ে আনছেন। এঁদের অনেকেই অবশ্য এ ব্যাপারে একমত যে, নোট পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে বড় মেয়াদে কিন্তু ভারতের শেয়ার বাজার চড়ার সম্ভাবনা প্রবল। অর্থাৎ কম দামের সুযোগ নিয়ে ভাল শেয়ার অল্প অল্প করে তুলতে শুরু করা যায়। বাজার আরও পড়তে পারে, এই আশঙ্কায় মানুষের ঝোঁক এখন বেশি ডেট ফান্ড এবং লিকুইড ফান্ডের প্রতি। পড়তি সুদের বাজারে ঋণপত্র নির্ভর ফান্ডগুলি বেশ আকর্ষণীয় আয়ের সন্ধান দিচ্ছে। মিউচুয়াল ফান্ড শিল্পের আশা, আগামী কয়েক মাসে ডেট ফান্ডে লগ্নি ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে উঠতে পারে।
দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও প্রবীণ নাগরিকদের সবাই এখনও পেনশন বাবদ নগদ টাকা হাতে পাননি। আগামী কয়েক মাস ধরে চলবে এই যন্ত্রণা। এখানেই শেষ নয়। যদি মোদী সরকারের নোট ছাঁটাইয়ের পরে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদ ছাঁটাই করে, তা হবে গোদের উপর বিষফোড়ারই সামিল। আর, সেই সম্ভাবনা বেশ প্রবল। আগামী ৬ এবং ৭ ডিসেম্বর ঋণনীতি পর্যালোচনা করবে দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্ক। নতুন রেপো রেট ঘোষণা করা হতে পারে বুধবার। আর এক প্রস্ত সুদ কমানো হলে ‘অচ্ছে দিন’ থেকে কয়েক যোজন দূরে সরে যাবেন অসংখ্য সুদ নির্ভর মানুষ। সুদ কমবে, কিন্তু তহবিল বাড়ার কোনও সুযোগ থাকবে না। আয় কমলে সব রকম শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে কোনও রকমে জীবন ধারণই হবে লক্ষ্য। এই কথা মাথায় রেখে যাঁদের পেনশনের সুবিধা নেই এবং ১০ বছরের মধ্যে অবসর নিতে চলেছেন তাঁদের এখন থেকেই অবসরের জন্য বড় তহবিল গড়ার কাজে নামতে হবে।
বর্তমানের সামান্য ত্যাগ ভবিষ্যতের চিন্তা অনেকটাই লাঘব করবে। দীর্ঘ মেয়াদে অল্প অল্প করে করমুক্ত ভাল প্রকল্পে নিয়মিত জমিয়ে গেলে তা মেয়াদ শেষে বড় তহবিলে পরিণত হতে পারে। এ ব্যাপারে পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ডের জুড়ি মেলা ভার। পাশাপাশি এস আই পি-র মাধ্যমে নিয়মিত লগ্নি চালিয়ে যাওয়া যায় ভাল ব্যালান্সড ফান্ডে। অবসরপ্রাপ্তরা পুরনো জমার মেয়াদ শেষে ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পের অধীন সিনিয়র সিটিজেন্স সেভিং স্কিম বা প্রবীণ নাগরিক সঞ্চয় প্রকল্পে ৫ বছরের জন্য ৮.৫% সুদে রাখতে পারেন। মনে রাখতে হবে জানুয়ারিতে আর এক প্রস্ত সুদ কমার সম্ভাবনা আছে ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পগুলিতে।
নোট কাণ্ড ও ফেড রেট বাড়ার সম্ভাবনায় কিছু দিন অনিশ্চিতই থাকবে শেয়ার বাজার। সূচক আরও কিছুটা পড়তে পারে। এই পরিস্থিতিতে পছন্দের শেয়ার বাছাই করে অপেক্ষা করুন। আর এক ধাপ নামলেই কিনতে শুরু করুন। একদম তলানির জন্য অপেক্ষা করলে হয়তো কেনাই হবে না। একটু সদর্থক বার্তা পেলেই বাজার উঠতে শুরু করবে বলে আশা করা যায়। তবে অপেক্ষার সময় ৩ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত হতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy