Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
জোর সন্ধান বিকল্প হিসাবের

দ্রুততম বৃদ্ধির দেশে বিবর্ণ অর্থনীতির ছবি

কেউ দেখছেন গ্রামে মোটরবাইক বিক্রি, তো কেউ নজর রাখছেন রেলে পণ্য পরিবহণের পরিসংখ্যানে।সরকারি হিসাব অনুযায়ী এই মুহূর্তে ভারতে বৃদ্ধির যা হার, তার সঙ্গে অর্থনীতির আসল ছবি মেলাতে হিমসিম অনেক বিশেষজ্ঞই।

নয়াদিল্লি ও মুম্বই শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:১৭
Share: Save:

কেউ দেখছেন গ্রামে মোটরবাইক বিক্রি, তো কেউ নজর রাখছেন রেলে পণ্য পরিবহণের পরিসংখ্যানে।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী এই মুহূর্তে ভারতে বৃদ্ধির যা হার, তার সঙ্গে অর্থনীতির আসল ছবি মেলাতে হিমসিম অনেক বিশেষজ্ঞই। তাই শুধু বৃদ্ধির সরকারি তথ্যে ভরসা না-রেখে অর্থনীতির নাড়ি টিপে দেখতে আরও বেশি করে বিকল্প পদ্ধতির হাত ধরছেন তাঁরা। বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতির মেঘলা আকাশে ভারত এই মুহূর্তে অন্যতম উজ্জ্বল বিন্দু ঠিকই। কিন্তু সাড়ে ৭ শতাংশের কাছাকাছি হারে বাড়তে থাকা কোনও অর্থনীতির ছবি যেমন জমকালো হওয়া উচিত, ভারত তার তুলনায় অনেকটাই বিবর্ণ। এমনকী বৃদ্ধির নিরিখে এই মুহূর্তে চিনকে টপকে ভারত সত্যিই দ্রুততম কিনা, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করছেন কেউ কেউ।

সম্পদ পরিচালনা সংস্থা অ্যাম্বিট ক্যাপিটালের নিজস্ব হিসেব অনুযায়ী, অক্টোবর-ডিসেম্বর ত্রৈমাসিকে ভারতে বৃদ্ধির হার ছিল ৫ থেকে ৬ শতাংশ। যে কারণে তাদের অর্থনীতিবিদ রীতিকা মানকর মুখোপাধ্যায় সরাসরি বলছেন, ‘‘ভারত বিশ্বে দ্রুততম বৃদ্ধির দেশ নয়।’’ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গবেষণা পদ্ধতির বিষয়ে ওয়াকিবহাল এক কর্তার মতেও, ‘‘মনে হচ্ছে না যে, দেশের অর্থনীতি ৭-৮ শতাংশ হারে বাড়ছে।’’ এই একই প্রশ্ন ঠারেঠোরে তুলছেন আরও অনেকেই।

রীতিমতো পরিসংখ্যান সাজিয়ে বিশেষজ্ঞরা দেখাচ্ছেন, অধিকাংশ সংস্থার আর্থিক ফলাফল থেকে স্পষ্ট যে, তাদের বিক্রিবাটা ভাল নয়। ব্যাঙ্ক থেকে ধার নেওয়ার চাহিদা সে ভাবে বাড়ছে না। ভাটা কাটেনি বেসরকারি বিনিয়োগে। জমি-জট, লাল ফিতের ফাঁস সমেত বিভিন্ন কারণে থমকে রয়েছে বহু প্রকল্প। যে কারণে শত চেষ্টাতেও রাশ টানা কঠিন হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির অনুৎপাদক সম্পদে। তাই তাঁদের প্রশ্ন, বৃদ্ধির নিরিখে যে দেশ দুনিয়ায় সবার আগে দৌড়চ্ছে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চাল সেখানে এমন আধসেদ্ধ কেন?

পরপর দু’বছর বৃষ্টিতে ঘাটতির দরুন গ্রামাঞ্চলে চাহিদায় টান এখন চোখে পড়ার মতো। ভোগ্যপণ্য ও পরিষেবা বিকোচ্ছে কম। ঔরঙ্গাবাদে মহীন্দ্রা অ্যান্ড মহীন্দ্রার এক ট্রাক্টর ডিলার জানাচ্ছেন, এ বছর তাঁর বিক্রি এক ঝটকায় কমে গিয়েছে ২০%। তাঁর কথায়, ‘‘দু’বছর ভাল বৃষ্টি হয়নি। কৃষকদের ক্রয় ক্ষমতা তলানিতে। বিক্রি কমেছে সেই কারণেই।’’ একই ভাবে, দেশের প্রায় সমস্ত বড় শহরে অনেকখানি কমে গিয়েছে ফ্ল্যাটের বিক্রিবাটা। বহু বাড়ি পড়ে রয়েছে অবিক্রিত অবস্থায়। অর্থনীতিবিদদের প্রশ্ন, সাড়ে ৭ শতাংশের কাছাকাছি হারে বাড়তে থাকা অর্থনীতিতে শহর ও গ্রাম দু’জায়গাতেই চাহিদা এমন তলায় পড়ে থাকে কী ভাবে?

এর আগে অর্থ মন্ত্রকের এক উচ্চপদস্থ কর্তা দাবি করেছিলেন, বৃদ্ধির চাকায় গতি বাড়াতে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে সরকারি লগ্নি বাড়ানোর কথা বলেছেন কয়েক জন পরামর্শদাতা। তার জন্য আপাতত রাজকোষ ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা শিথিল করারও পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। জেটলির দরবারে এই একই দাবি জানিয়েছে শিল্পমহলের একাংশও। তখনও অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন, সম্প্রতি কেন্দ্র চলতি আর্থিক বছরের জন্য বৃদ্ধির পূর্বাভাস কিছুটা শিথিল করেছে ঠিকই। কিন্তু তা বলে ভারতকে বিশ্বে দ্রুততম বৃদ্ধির দেশ হিসেবে দাবি করা থেকে সরে আসেনি। তা হলে সেই দেশের অর্থনীতির চাকায় গতি ফেরাতে ত্রাণ প্রকল্প ঘোষণা জরুরি হবে কেন, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।

দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) কী ভাবে এবং কোন তথ্যের (ডেটা) ভিত্তিতে মাপা হবে, সেই দু’য়েই বদল এনেছে মোদী সরকার। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, সেই মাপকাঠি মেনে করা হিসেবে আসন্ন বাজেটে ৭.৩% বৃদ্ধির কথা বলবেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু ওই হিসেব-নিকেশের পদ্ধতি বদল কতটা যুক্তিসঙ্গত, গোড়া থেকেই তা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠছে। মনমোহন সিংহের জমানায় প্রধানমন্ত্রীর প্রাক্তন মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা সি রঙ্গরাজনও সম্প্রতি কলকাতায় এসে বলে গিয়েছেন, বৃদ্ধির পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাঁর মতে, জিডিপি হিসেবের নতুন পদ্ধতিতে ভুল নেই। কিন্তু প্রশ্ন রয়েছে, যে ডেটার ভিত্তিতে তা করা হচ্ছে, সেটি নিয়ে।

এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বলেই শুধু বৃদ্ধির পরিসংখ্যানে আস্থা না-রেখে অর্থনীতির আসল ছবির সন্ধানে আরও বেশি করে বিকল্প রাস্তার সন্ধান করছেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন, নতুনের সঙ্গে পুরনো পদ্ধতির একটা মিশেল বজায় রেখেছে খোদ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। সেই সঙ্গে তারা দেখছে দু’চাকার গাড়ি বিক্রি, রেলে পণ্য পরিবহণ, গ্রামে ভোগ্যপণ্যের বিক্রি ইত্যাদি। অ্যাম্বিট আবার এ সবের পাশাপাশি চোখ রাখছে বিদ্যুতের চাহিদা, মূলধনী পণ্যের আমদানি ইত্যাদিতে। এ ক্ষেত্রে গাড়ি বিক্রির পাশাপাশি সিটি গ্রুপের নজর আবার বিমানযাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি, ডিজেলের বিক্রি ইত্যাদির উপর।

অ্যাম্বিটের মতে, যে দিক থেকেই দেখা হোক বা যে ভাবেই বিশ্লেষণ করা হোক না কেন, সার্বিক ভাবে অর্থনীতির উজ্জ্বল ছবি সেখানে ধরা পড়ছে না। তথ্যপ্রযুক্তি, ই-কমার্সের মতো কয়েকটি শিল্পের দশা হয়তো তুলনায় ভাল। কিন্তু অর্থনীতির বড় অংশই পা ফেলছে কচ্ছপের গতিতে। অর্থাৎ, সরকারি পরিসংখ্যানের সঙ্গে তাল মেলানো খরগোশের ছটফটানি সেখানে নেই। –সংবাদ সংস্থা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE