কোনও বাচ্চাকে প্রথম বার হাঁটতে দেখেছেন? বাবা-মায়ের হাত, চেয়ার, টেবিল, খাট থেকে শুরু করে সামনে যা কিছু মেলে, তাতে আলতো ভর দিয়ে পা ফেলার চেষ্টা। টলমল পায়ে কিছুটা এগিয়ে কখনও বসে যাওয়া। কখনও মৃদু আছাড়ও। শেয়ার বাজারে প্রথম পা রাখাও অনেকটা সে রকম। যেখানে শুরুতে হয়তো আপনি হোঁচট খাবেন। কিন্তু জেদ ধরে থাকলে, শেষমেশ হাঁটা সেই শিখেই যাবেন আপনি। শর্ত শুধু দু’টো। এক, ধৈর্য হারালে চলবে না। আর দুই, দেশ-বিদেশে কী ঘটছে এবং বাজারের উপর তার প্রভাব কী— প্রায় সারাক্ষণ তার উত্তর খুঁজে চলার একটা জিজ্ঞাসু মন থাকতে হবে আপনার মধ্যে। এ বার বলুন, আপনি তৈরি তো?
অনেকে প্রশ্ন করেন, ঠিক কখন প্রথম পা রাখা ঠিক হবে বাজারে। সত্যি বলতে কি, তার নির্দিষ্ট কোনও উত্তর নেই। বাজার চড়া, নিচু কিংবা উথালপাথাল— যেমনই থাকুক, তার প্রত্যেকেরই কিছু নিজস্ব সুবিধা বা অসুবিধা রয়েছে। রয়েছে সমস্যা সামাল দেওয়ার কৌশলও। তাই অযথা তা নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। বরং আমি বলব, শুভস্য শীঘ্রম।
অনিশ্চয়তা থাকবেই
এক দিন সূচক ১০০ পয়েন্ট উঠল, তো পরের দিনই আবার তা ২০০ পয়েন্ট পড়ে গেল। শেয়ার বাজার এ ভাবেই চলে। ফলে সেই অনিশ্চয়তা থাকবে ধরে নিয়েই আপনাকে এগোতে হবে। মনে রাখবেন, বাজার কিন্তু প্রতিদিনই লগ্নির সুযোগ দেবে। তাতে থাকবে ঝুঁকিও। তাই আপনি কতটা ঝুঁকি নিতে চান, তা শুরুতে মোটামুটি ভেবে নিয়ে তবেই পা রাখুন এই জগতে।
শুধু মনে রাখবেন, যাঁরা পোড় খাওয়া লগ্নিকারী, তাঁরা বাজারের খুঁটিনাটি জানেন। ফলে তাঁদের পক্ষে লোকসানকে পাশ কাটানো কিছুটা সুবিধাজনক। কিন্তু যাঁরা আনকোরা, তাঁদের বাড়তি সতর্ক হতে হবে।
উঁচু বাজার, নিচু বাজার
কয়েক বছর আগে সেনসেক্স ২০ হাজারে থাকাকেই চড়া বাজার বলে মনে করা হত। অথচ এখন ৩৩-৩৫ হাজারও গা সওয়া। তার মানে, বাজারের শৃঙ্গ বলে কিছু নেই। আজ যে ৩৬ হাজারকে হয়তো বিরাট উচ্চতা মনে হচ্ছে, বছর কয়েক পরে তাকেই হয়তো বামন দেখাবে। আবার বাজার নাগাড়ে পড়তে শুরু করলে, ওই ৩৬ হাজারের উচ্চতাকেই মনে হবে লোভনীয়। পুরোটাই আপেক্ষিক।
সুতরাং সমস্ত রকম পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকা ভাল। প্রস্তুত থাকা জরুরি হঠাৎ চমকের জন্য। আমেরিকার টুইন টাওয়ারে বিমান গোত্তা মারায় যে সারা বিশ্বের বাজার ধসে যেতে পারে, তা কি কেউ কল্পনা করেছিলেন কখনও।
এ ধরনের ঘটনা আগাম আঁচ করা যায় না। কিন্তু এমনটা যে ঘটতে পারে, মানসিক ভাবে তার জন্য তৈরি থাকা ভাল। একটু ছড়িয়ে রাখা উচিত সঞ্চয়ের ডিম। যাতে অকস্মাৎ কোনও ধাক্কা এলে, কিছু অন্তত বাঁচে।
গোলকধাঁধা
অনেক সময়েই এমন হয় যে, কোনও সংস্থার আর্থিক ফল বেশ ভাল হয়েছে। অথচ তার শেয়ার দর পড়ল। কখনও বা উল্টোটা। আবার শিল্পবৃদ্ধি বা মূল্যবৃদ্ধির পরিসংখ্যান ভাল হওয়ার পরের দিন দেখা গেল বাজার পড়ছে! আবারও বলছি, এমনটা ঘটতেই পারে। কিন্তু সাধারণত অর্থনীতি ভাল করার গন্ধ পেলে দীর্ঘ মেয়াদে মুখ তোলে বাজার। তাই সেই লক্ষণগুলি জেনে রাখা ভাল। যেমন—
• অর্থনীতির ভিত কেমন: রাজকোষ ঘাটতি, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কি না, দেশে শিল্পের হাল কী রকম, রফতানি ভাল হচ্ছে কি না ইত্যাদি। এগুলি বাজারের উপরে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। এখন যেমন বাজারকে নড়বড়ে রেখেছে ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদ নিয়ে চিন্তা।
• নজর সুদেও: রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদ কমাচ্ছে বা বাড়াচ্ছে কি না, বন্ডের ইল্ড উঠছে না পড়ছে— এ সবেরও প্রভাব বাজারে পড়ে। ফলে শেয়ারে টাকা খাটাচ্ছি বলে সুদে বা বন্ডের রিটার্নে নজর দেব না, এমন যেন না হয়।
• রাজনৈতিক অস্থিরতা: দেশে নির্বাচন হোক অথবা বিদেশে যুদ্ধের পরিস্থিতি, খেয়াল করে দেখবেন রাজনৈতিক ঘটনা সব সময়েই বাজারে ছাপ ফেলে। যেমন, গত বছরের একটা বড় সময় জুড়ে ট্রাম্প এবং কিমের হুমকি-পাল্টা হুমকির জেরে অস্থির ছিল সূচক। আবার এখন ট্রাম্পের ইরান চুক্তি খারিজের সিদ্ধান্তে বেড়েছে অশোধিত তেলের দাম। যা চাপে ফেলেছে বাজারকে।
• চোখ রোজকার লেনদেনে: এমন অনেকে রয়েছেন, যাঁরা প্রতিদিনই শেয়ার কেনেন এবং বিক্রি করেন। আবার অনেকে কয়েক দিন থেকে কয়েক মাস তা ধরে রাখেন। শেয়ারের দরের ওঠাপড়ার এগুলিও অন্যতম কারণ। ফলে কোনও শেয়ার কী ভাবে উঠছে বা পড়ছে এবং দিনে কত টাকার ও কতগুলি শেয়ার হাতবদল হচ্ছে, সেই সমস্ত বিষয় খেয়াল রাখতে পারলে সুবিধা আপনারই।
অনেকে আবার হাতে শেয়ার না থাকলেও, আগে থেকে তা বিক্রি করে রাখেন দিনের শেষে কিনবেন বলে। এ ভাবে লেনদেন ঝুঁকির। অন্তত শুরুতে না করাই ভাল। বরং ফাটকা এড়িয়ে ভাবুন দীর্ঘ মেয়াদি লগ্নির কথা।
সব সময়েই সত্যি
উঁচুই হোক বা ঝিমিয়ে থাকা বাজার। শেয়ারে লগ্নির কিছু চিরন্তন নিয়ম আছে। সেগুলি হল—
• যে সংস্থা বাছছেন, তাদের আর্থিক জোর, পরিচালন ব্যবস্থা, দীর্ঘ মেয়াদে তার ব্যবসার লক্ষ্য, আধিপত্য বজায় থাকার সম্ভাবনার মতো বিষয় খেয়াল রাখুন। বাজারে প্রথম পা রাখার সময়ে প্রতিষ্ঠিত সংস্থা বাছতে পারলে ভাল। এগুলির ইতিহাস নেট ঘাঁটলে পেয়ে যাবেন। বাছাইয়ে সুবিধা হবে।
• লোকের কথা শুনে নয়, নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিন।
• পোর্টফোলিওয় নজর রাখুন। খবর রাখুন সংস্থা ও বাজার সম্পর্কে।
• লগ্নি কৌশল বেশি বদলাবেন না। অবস্থা দেখে বদল অবশ্যই জরুরি। কিন্তু তা বলে ঘনঘন নয়।
• কতটা রিটার্ন আশা করেন, সে সম্পর্কে যেন স্পষ্ট ধারণা থাকে। যদি দেখেন লক্ষ্যে পৌঁছেছেন, তা হলে শেয়ার বেচে বেরিয়ে আসুন। মনে করুন, ১০ টাকায় কেনা শেয়ার ১৫ টাকায় পৌঁছলে বেচবেন ঠিক করেছেন। সে ক্ষেত্রে লোভের বশে অনন্ত কাল তা ধরে রাখা কিন্তু কাজের কথা নয়। বরং ১৫ টাকা বা তার সামান্য বেশিতে মুনাফার কড়ি ঘরে তুলে ফের তা বাজারে লগ্নির কথা ভাবতে পারেন। এতে ঝুঁকিও কম।
• ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা মাথায় রাখুন। বাড়তি লাভের আশায় বেশি ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়। তাই কম ঝুঁকি পছন্দ হলে, কম থেকে মাঝারি রিটার্নে খুশি থাকুন।
• স্বল্প মেয়াদে যে সব শেয়ারের দাম খুব ওঠানামা করছে, সেখানে টাকা ঢালার আগে সাবধান থাকুন। বাজারে কোনও সংস্থা নিয়ে জল্পনা চলছে, এমন শেয়ারে টাকা ঢালবেন না।
• শেয়ারের দর প্রতিদিন ওঠানামা করবেই। এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই।
• কোনও শেয়ার কেনা মানে আপনি সেই সংস্থার অংশীদার। সংস্থাগুলি নানা সময়ে নিজেদের তথ্য নেটে দেয় বা ই-মেল মারফত পাঠায়। সেগুলি মন দিয়ে পড়ুন। খেয়াল রাখুন, তাদের সুনাম, ব্যবসা বৃদ্ধির সম্ভাবনা ইত্যাদি প্রশ্নের মুখে পড়ছে কি না।
বাজার যখন উঠছে
যদি দেখেন বাজার উঠছে, তখন নির্দিষ্ট কিছু ফর্মুলা মেনে চলতে পারলে ভাল। যেমন—
• রেকারিংয়ে শেয়ার: রেকারিং ডিপোজিট অথবা মিউচুয়াল ফান্ডে এসআইপিতে যেমন প্রতি মাসে টাকা রাখি, সেই পদ্ধতি মেনে চলুন।
• একসঙ্গে নয়: মোট যত টাকা শেয়ারে খাটাবেন বলে ঠিক করেছেন, তা ভাঙুন নির্দিষ্ট অঙ্কে। এ বার সুযোগ বুঝে সেই টাকা দিয়ে শেয়ার কিনতে থাকুন। এতে দামের ওঠা-পড়ার আঁচ এড়াতে পারবেন। এক সঙ্গে সব টাকা জলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। পছন্দের শেয়ারও হাতে আসবে। ৫০ টাকা দিয়ে পাঁচ বারে ১০ টাকার শেয়ার কিনলে ঝুঁকি তো কম হবেই।
• বেশি ছড়াবেন না: লগ্নি করতে হবে বলেই একগাদা সংস্থার শেয়ারে টাকা ঢালবেন না। বরং সীমিত সংখ্যক ভাল শেয়ার কিনুন। সময়-সুযোগ বুঝে সেই শেয়ারের সংখ্যা বাড়ান।
• ভাবুন দীর্ঘ মেয়াদে: পছন্দমতো রিটার্ন না মেলা পর্যন্ত তা বিক্রি না করা ভাল। ধৈর্যের বিকল্প নেই। সামান্য পতনে আতঙ্কিত হবেন না।
• তুলুন মুনাফা: বেশি ঝুঁকি নিতে না চাইলে এবং চড়া বাজারে দর ভাল উঠলে, তখন শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা ঘরে তুলতে পারেন। পুরো টাকা তুলতে না-চাইলে হাতে থাকা শেয়ারের একটা অংশ বিক্রি করে বাকিটা ধরে রাখুন। যখনই দেখবেন শেয়ারের দামে বেশ ভাল পতন হয়েছে, তখনই তাতে লগ্নি করুন।
• আফশোস করবেন না: এক বার যদি শেয়ার বিক্রি করেন এবং পরে দেখেন তার দাম আরও বাড়ছে, তখন আফশোস করবেন না। এতে পরে শেয়ার বাছাইয়ে অসুবিধা হতে পারে।
সূচক যখন নামছে
শেয়ার বাজার যখন নামছে, তখন সেখানে পা রাখার ভাল সময়। কারণ তখন কম দামে ভাল শেয়ার পাওয়া যায়। কিন্তু এখানেও কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। সেগুলি হল—
• বাছাইয়ে নজর দিন: বাজার পড়ার সময়ে অনেক ক্ষেত্রে ভাল শেয়ারের দামও এমন জায়গায় নেমে আসে, যাতে তুলনায় খারাপ শেয়ারের সঙ্গে তার তফাৎ বোঝা যায় না। তাই সংস্থা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বাড়তি নজর দিন। দেখুন, শুধু বাজার পড়ছে বলেই আপনার পছন্দের শেয়ারের দাম নামছে? নাকি সংস্থার নিজস্ব কোনও সমস্যা রয়েছে। নজরে রাখুন তার আর্থিক ফল, ঋণের অঙ্ক, ডিভিডেন্ডের ইতিহাসও।
• অপেক্ষা করুন: সংস্থা বাছাই করার পরে অপেক্ষা করুন তার দাম পড়ার জন্য। যদি দেখেন ভাল রকম দাম নেমেছে, তখন সেখানে লগ্নি করুন। কিন্তু শেয়ার কেনার পরে যদি দেখেন দাম আরও পড়ছে, তা হলে ভয় না পেয়ে তা ধরে রাখুন। সংস্থা সম্পর্কে ভাল করে জেনে যদি টাকা ঢালা যায়, তা হলে বাজার যখন উঠবে, তখন সেই শেয়ার চড়া মুনাফা দিতে পারে।
দুলছে বাজার
যদি বেশি দিন শেয়ার ধরে না রাখেন, তাহলে দোদুল্যমান বাজারেও অসুবিধা নেই। তবে মাথায় রাখুন—
• খোলা মন জরুরি: ধরুন ভেবেছেন ব্যাঙ্কের শেয়ারে টাকা ঢালবেন, কিন্তু শুধু সেই জন্য বসে থাকবেন না। যদি দেখেন পড়তি বাজারে অন্য কোনও শিল্পের ভাল শেয়ার কম দামে পাওয়া যাচ্ছে, তা হলে তাতে টাকা রাখুন।
• ঝুঁকি সামলান: আপনি হয়তো বেশি ঝুঁকি নিতে রাজি নন। সে ক্ষেত্রে শুধু শেয়ারের ভরসাতেই না থেকে ইকুইটি ফান্ডেও টাকা রাখতে পারেন।
লেখক: বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)
পরামর্শের জন্য লিখুন:
‘বিষয়’, ব্যবসা বিভাগ,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা, পিন-৭০০০০১।
ই-মেল: bishoy@abp.in
ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানাতে ভুলবেন না
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy