Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

হাতে আর তিন দিন

জিএসটি-তে প্রথম বার রিটার্ন ও কর জমার মরসুম চলছে এখন। ২০ তারিখ জুলাইয়ের কর এবং প্রথম রিটার্ন দাখিলের শেষ দিন। মনে করালেন তিমিরবরণ চট্টোপাধ্যায়পণ্য-পরিষেবা কর বা জিএসটি-র পথ চলা শুরু হল ১ জুলাই থেকেই। এর মূলমন্ত্র যে এক দেশ-এক কর কিংবা স্বাধীনতার পরে পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে এটি যে সম্ভবত বৃহত্তম সংস্কার, এই সমস্ত কথা এত দিনে বহু বার শুনে ফেলেছি আমরা।

শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৭ ০৮:৩০
Share: Save:

অবশেষে বহু দিনের তর্ক-বিতর্ক, টালবাহানায় দাঁড়ি পড়ল ৩০ জুন মধ্যরাতে। সংসদের সেন্ট্রাল হলে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশ জুড়ে চালু হয়ে গেল পরোক্ষ করের নতুন জমানা। পণ্য-পরিষেবা কর বা জিএসটি-র পথ চলা শুরু হল ১ জুলাই থেকেই। এর মূলমন্ত্র যে এক দেশ-এক কর কিংবা স্বাধীনতার পরে পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে এটি যে সম্ভবত বৃহত্তম সংস্কার, এই সমস্ত কথা এত দিনে বহু বার শুনে ফেলেছি আমরা। এও ঠিক যে, জিএসটি নিয়ে সব ধারণা এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে অনেক জায়গায়। কিন্তু পরীক্ষার ঠিক মুখে যেমন পুরো বই পড়ার সময় হাতে থাকে না, এখন আমাদেরও হাল কিছুটা যেন তেমনই। শুরু হয়ে গিয়েছে প্রথম বার জিএসটি রিটার্ন ও কর জমার মরসুম। জুলাইয়ের জন্য প্রথম রিটার্নটি দাখিলের শেষ দিন ২০ অগস্ট। ওই মাসের জন্য জিএসটি জমা দেওয়ারও শেষ দিন সেটাই। ফলে শিয়রে সংক্রান্তি।

কোমর বাঁধতে

ইতিমধ্যেই মাস দেড়েক বয়স পেরিয়েছে জিএসটি-র। করদাতারা পা রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ এক মোড়ে। প্রথম বার রিটার্ন ও কর জমা দিচ্ছেন তাঁরা। কাজ সারার জন্য আর বেশি দিন হাতে নেই। এমনিতে প্রতি মাসের রিটার্ন যখন দিতে হবে, তার থেকে এই জুলাই ও অগস্টের তারিখ কিছুটা আলাদা (সঙ্গের সারণি দেখুন)। নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে সকলকে একটু সড়গড় হওয়ার সময় দিতেই এই বন্দোবস্ত। তবু জুলাইয়ের জন্য প্রথম রিটার্নটি (জিএসটিআর-৩বি) জমার শেষ তারিখ কিন্তু ২০ অগস্ট। ওই মাসের করও সেই দিনের মধ্যে মেটাতে হবে।

এখানে একটা কথা গোড়াতেই বলে রাখা ভাল। জিএসটি-র রিটার্ন ও কর জমার পদ্ধতি প্রায় পুরোটাই নেট ভিত্তিক। আর সেটিই ঝাঁকুনি দিতে পারে অনেক সংস্থাকে। বিশেষত ছোট ও মাঝারিদের। যাদের পক্ষে শুধু জিএসটি সামলানোর জন্য আলাদা করে পেশাদার নিয়োগের তেমন সুযোগ নেই। তাই বিষয়টি সকলের কাছে কী করে কিছুটা সরল করা যায়, তা নিয়েই আজকের আলোচনা।

মাথায় রাখুন

• ব্যবসা ২০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হলে জিএসটি নথিভুক্তি জরুরি নয়।

• তবে তা ২০ লক্ষ পেরিয়ে গেলে বাধ্যতামূলক। ফলে অনেক ছোট-মাঝারি সংস্থা এসেছে করের জালে।

• বছরে ৭৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ব্যবসা করলে একটি বিকল্প সোজা নিয়মও আছে। শর্ত, ব্যবসা করতে হবে শুধু রাজ্যে। এটির নাম কম্পোজিশন স্কিম।

এতে নথিভুক্তির সুবিধা— প্রতি ত্রৈমাসিকে একটি করে রিটার্ন দিলেই চলবে। ব্যবসায়ীদের জন্য জিএসটি ১%। উৎপাদনকারীদের ২%।

অসুবিধা— ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিটের সুবিধা মিলবে না। সামান্য কর দিতে হবে বলে ক্রেতাদের থেকে সেই টাকা উসুলের পথ বন্ধ। রেস্তোরাঁ ছাড়া পরিষেবা শিল্পের অন্য ক্ষেত্র প্রকল্পটির সুবিধা নিতে পারবে না।

• জিএসটি-তে পরিষেবা প্রদানকারীদের জন্য ছাড়ের সর্বোচ্চ সীমা ১০ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০ লক্ষ টাকা। ফলে উপকৃত হবে ছোট মাপের পরিষেবা সংস্থাগুলি।

• পণ্য-পরিষেবা সরবরাহের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী যে পণ্য ও পরিষেবা কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করবেন, সেই বাবদ খরচের উপর গোনা করের টাকা ফেরত মিলবে। এরই নাম ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট।

কী ভাবে, কখন

জিএসটি-র প্রাথমিক যে-শর্তগুলি মনে রাখতে হবে, সেগুলি হল—

• কোনও মাসের জিএসটি দিতে হবে তার পরের মাসের ২০ তারিখের মধ্যে।

• এ জন্য করদাতার জিএসটি আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (জিএসটিআইএন) থাকতে হবে। সেই অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট পোর্টালে (www.gst.gov.i• বা www.cbec.gov.i•) যে অনলাইন চালান থাকবে, তা পূরণ করতে হবে।

• সম্মিলিত জিএসটি (আইজিএসটি), কেন্দ্রীয় জিএসটি (সিজিএসটি) এবং রাজ্য জিএসটি (এসজিএসটি)— তিন ধরনের করই চোকাতে হবে একটিমাত্র চালানের মাধ্যমে।

• করের টাকা দিতে হবে অনলাইনে। নেট ব্যাঙ্কিং, ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে।

• তবে হাতে-হাতে জিএসটি দেওয়ার সুযোগ মিলবে কর মেটানোর প্রত্যেক মেয়াদে, চালান পিছু ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। নগদে, চেকে, ডিমান্ড ড্রাফ্ট মারফত দেওয়া যাবে তা।

কোন রিটার্ন, কবে

এ বার আসি রিটার্ন জমার কথায়। জিএসটি রিটার্ন দাখিলের জন্য বেশ কয়েক ধরনের ফর্ম রয়েছে। যা জমা দিতে হবে জিএসটি-র পোর্টালে গিয়ে। ফলে কখন, কোনটি, কীসের জন্য জমা দিতে হবে, সেটা খুব বড় প্রশ্ন—

জিএসটিআর-১: জিএসটি আইন অনুযায়ী, এই রিটার্ন ফর্ম দাখিল করতে হবে ব্যবসার অঙ্গ হিসেবে যে সব পণ্য বা পরিষেবা সরবরাহ (আউটওয়ার্ড সাপ্লাই) করা হচ্ছে, তার জন্য। সেখানে দেখাতে হবে সেই সরবরাহের তথ্য (যেমন: বিক্রি, আন্তঃ-রাজ্য শাখার মধ্যে স্থানান্তর, লিজ বা ভাড়া দেওয়া, পণ্য-পরিষেবা জোগাতে নেওয়া অগ্রিম ইত্যাদি) এবং তার উপর কর। যে মাসের হিসেব, তার পরের মাসের ১০ তারিখের মধ্যে জমা দিতে হবে এই রিটার্ন।

জিএসটিআর-২: এই রিটার্ন ফর্ম দিতে হবে ব্যবসা চালাতে যে-সব পণ্য বা পরিষেবা নেওয়া (ইনওয়ার্ড সাপ্লাই) হচ্ছে, তার জন্য। সেখানে দেখাতে হবে সেগুলি পাওয়ার তথ্য (যেমন: ক্রয়, আন্তঃ-রাজ্য শাখার মধ্যে স্থানান্তর, ক্রেডিট নোটস, ডেবিট নোটস ইত্যাদি) এবং তার উপর কর। এই রিটার্নের বেশির ভাগটাই ‘অটো পপুলেটেড’। অর্থাৎ ফর্মে আগে থেকেই কিছু কিছু তথ্য ও হিসেব ভর্তি হয়ে থাকবে ব্যবসায়ীর (সরবরাহকারীর) জমা দেওয়া জিএসটিআর-১ ফর্মটির ভিত্তিতে। ফলে সেই অং‌শ করদাতাকে আর ভর্তি করতে হবে না। এই ফর্মেই থাকবে ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট দাবির অঙ্ক। এটি পরের মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে জমা দিতে হবে।

জিএসটিআর-৩: এটি সম্মিলিত মাসিক রিটার্ন দাখিলের ফর্ম। এই রিটার্নও ‘অটো পপুলেটেড’। অর্থাৎ করদাতার জমা দেওয়া জিএসটিআর-১ বা জিএসটিআর-২ জমা দেওয়ার পরে, সেগুলির ভিত্তিতে এই ফর্মের বিভিন্ন অংশ ভর্তি হয়ে যাবে আগেই। নিট কর কত দেওয়া হল, তার পরিমাণ থাকবে এতে। পরের মাসের ২০ তারিখের মধ্যে জমা দিতে হবে এটি। তবে করের টাকা জমা দিলে তবেই তা নেওয়া হবে।

জিএসটিআর-৩বি: রিটার্নের এককালীন সার-সংক্ষেপ এই ফর্ম। আপাতত এটি শুধুমাত্র জুলাই ও অগস্টের জন্যই দিতে হবে। এই মুহূর্তে জুলাইয়ের জন্য এটি দাখিলের প্রক্রিয়া চলছে। ২০ তারিখ শেষ দিন। আগে করের টাকা জমা দিলে, তবেই এই ফর্ম নেওয়া হচ্ছে করদাতাদের থেকে।

জিএসটিআর-৯: সার্বিক বার্ষিক রিটার্ন দাখিলের ফর্ম। একে সারা বছরের সম্মিলিত রিটার্ন-ও বলা যায়। নিয়ম অনুযায়ী, কোনও অর্থবর্ষের জন্য তার পরের আর্থিক বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এটি জমা দিতে হবে।

হাতেনাতে

কেন্দ্র বারবার বলছে, জিএসটি আসায় কর ফাঁকির রেওয়াজ অনেক কমবে। এর কারণ কী? আসলে কর ব্যবস্থাটি তৈরিই হয়েছে এমন ভাবে যে, জিএসটিআর-১ ও জিএসটিআর-২ দাখিলের পরে জিএসটিআর-৩ দাখিলের আগে ব্যবসায়ীরা কর মেটাতে বাধ্য। তা না হলে সেই ফর্মটি জমাই দেওয়া যাবে না। কারণ, কর মেটানোর সময়সীমা মাসের ২০ তারিখ। আর জিএসটিআর-৩ জমার সময়ও শেষ হবে সেই একই দিনে। ফলে কর না-দিয়ে রিটার্ন জমা দিতে গেলেই আটকে যাবেন করদাতা। স্পষ্ট হয়ে যাবে তাঁর কর-বকেয়া। ফলে কর না-দিলে নিস্তার নেই।

এ ছাড়া, জিএসটি-তে নথিভুক্ত ব্যবসায়ীদের সব বিক্রি ও কেনার তথ্য আপনা থেকেই জিএসটি নেটওয়ার্ক (জিএসটিএন) পরিচালিত জিএসটি পোর্টালে রেকর্ড হয়ে যাবে। সুতরাং কোনও লেনদেন লুকোনোর জায়গাই নেই। ফলে তাঁদের অ্যাকাউন্টেও বিক্রি ও কেনার আসল মূল্য প্রতিফলিত হবে। যে কারণে কেন্দ্রের দাবি, এর ফলে এক দিকে যেমন সরকারের ঘরে অনেক বেশি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর জমা পড়বে, তেমনই চোখে পড়ার মতো কমবে কর ফাঁকির পরিমাণ।

ভুল শোধরাতে

জিএসটিআর-১ এবং জিএসটিআর-২ রিটার্ন ফর্ম ভরার ক্ষেত্রে কোথাও কোনও ভুল হয়ে গেলে তা শুধরে নেওয়া যাবে পরের বার। জিএসটি পোর্টালে ঢুকে তা ঠিক করা যাবে। তার জন্য সংশ্লিষ্ট লেনদেনের বিশদ তথ্য ফের জানাতে হবে তাঁকে।

সাবধান

কত বার ন্যায্য কর না-মিটিয়ে জিএসটি আইন ভাঙছেন করদাতা, তার উপর নির্ভর করবে জরিমানার অঙ্ক। কিন্তু শুধু যে জরিমানা দিয়েই নিস্তার মিলবে, তা নয়। প্রত্যেক বার আইন ভাঙার জন্য জিএসটি রেটিং কমবে ব্যবসায়ীর। যা ভবিষ্যতে তাঁর ব্যবসা করার পক্ষে বাধা হতে পারে।

মনে রাখবেন, এখন ব্যবসার সব কিছু নেট দুনিয়ায় রেকর্ড-বন্দি থাকবে। তাই সব সংস্থাকেই হিসাবের খাতায় মন দিতে হবে অনেক বেশি। গরমিলের গল্প ধরা পড়বে সহজেই।

ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট

জিএসটি-তে অন্যতম বড় সুবিধা হওয়ার কথা নগদের নির্ঝঞ্ঝাট ও নিরবচ্ছিন্ন জোগান। কারণ, পণ্য ও পরিষেবা সরবরাহের জন্য ব্যবসা করতে গিয়ে যে পণ্য ও পরিষেবা ‘কাঁচামাল হিসেবে’ ব্যবহার করা হবে, সেই বাবদ খরচের উপর গোনা করের টাকা ফেরত পাওয়ার সুবিধা রয়েছে নতুন কর জমানায়। এর নামই ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট।

যেমন, একটি দোকান চালাতে ব্যবসায়ীকে দোকান ভাড়ার উপর যে জিএসটি দিতে হবে, তা ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট হিসেবে ফেরত পাওয়া যাবে। আগে এই সুবিধা ছিল না।

লেখক কর বিশেষজ্ঞ

(মতামত ব্যক্তিগত)

পরামর্শের জন্য লিখুন:

‘বিষয়’, ব্যবসা বিভাগ,

আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা, পিন-৭০০০০১।

ই-মেল: bishoy@abp.in

ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানাতে ভুলবেন না

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

GST Tax Filing Income Tax জিএসটি
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE