১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট। স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্যরাতে সংসদের সেন্ট্রাল হলে কিংবদন্তি ‘ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’ বক্তৃতায় ইতিহাসে ঢুকে পড়েছিলেন জওহরলাল নেহরু। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। প্রায় সাত দশক পেরিয়ে সেই সেন্ট্রাল হলে ইতিহাসের পাতায় পাকা জায়গা করে নিতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। ৩০ জুন-১ জুলাইয়ের মধ্যরাতে সেখানেই ঘণ্টা খানেকের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে জিএসটি চালুর পরিকল্পনা করছে তাঁর সরকার।
স্বাধীন ভারতে পণ্য-পরিষেবা কর (জিএসটি) চালুই যে সব থেকে বড় মাপের কর-সংস্কার, সে বিষয়ে তেমন সন্দেহ নেই। মসৃণ ভাবে তা চালু হলে যে এক দেশ-এক কর-এক বাজারের পথে পা ফেলা যাবে, তা-ও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এই সমস্ত কিছুর পরেও বিরোধী-সহ অনেকেই বলছেন, এ আসলে মোদীর আগ মার্কা ‘ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট’। তাঁদের যুক্তি, হোক না বড় সংস্কার, শেষ পর্যন্ত তা তো নতুন কর চালু করার ঘোষণাই। তার জন্য এমন রাজকীয় আয়োজন আসলে মোদীর চতুর বিপণন। একই সঙ্গে তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ইউপিএ জমানায় একটা দীর্ঘ সময় এই পণ্য-পরিষেবা করের বিরোধিতায় সোচ্চার ছিলেন গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী!
প্রধানমন্ত্রীর দফতর অবশ্য এখন এই রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজনে ব্যস্ত। বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও সাংসদদের নিমন্ত্রণপত্র পাঠানোর দায়িত্ব সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী অনন্ত কুমারের। জিএসটি চালুর দশ দিন আগে, তার প্রস্তুতি নিয়ে মঙ্গলবার সমস্ত সচিবদের নিয়ে বৈঠক করেছেন ক্যাবিনেট সচিব পি কে সিন্হা। প্রচারের মুখ করা হয়েছে অমিতাভ বচ্চনকে। গালে তেরঙা আবির মেখে বিজ্ঞাপনে তিনি বলছেন, ‘‘এই তিন রঙের মতো জিএসটি-ও আমাদের এক সুতোয় বাঁধবে। জিএসটি— এক রাষ্ট্র, এক কর, এক বাজার।’’
মধ্যরাত। ১৯৪৭ সােলর ১৪ অগস্ট। সংসদের সেন্ট্রাল হলে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সেই বিখ্যাত ‘ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’ বক্তৃতা। পাশে শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ফাইল চিত্র
সরকার পক্ষের অনেকে বলছেন, কোনও দেশের স্বাধীনতা পাওয়ার সঙ্গে কখনওই কিছুর তুলনা চলে না। তা বলে গুরুত্বের দিক থেকে জিএসটি একেবারে পলকা নয়। সেই অটল বিহারী বাজপেয়ীর জমানা থেকে তা কত ওঠা-পড়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। কত কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে এ বিষয়ে সমস্ত রাজ্যের সায় পেতে। তাই সে দিক থেকে ওই কর চালুর মুহূর্ত নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক।
খোদ মোদীও এ দিন লখনউয়ে জিএসটি-কে ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ বলে দাবি করেছেন। একে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সাফল্য বলেও তুলে ধরেছেন তিনি। সরকারি সূত্রের দাবি, জিএসটি চালু হওয়াকে স্বাধীনতার মতো ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে তুলে ধরতেই সেন্ট্রাল হলে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন। প্রথমে না কি ঠিক হয়েছিল যে, বিজ্ঞান ভবনে অনুষ্ঠান হবে। সেখানে প্রেক্ষাগৃহের মাপও বড়। কিন্তু মোদীর নির্দেশেই প্রধানমন্ত্রীর দফতর জানায় যে, তা হবে সংসদের ঐতিহাসিক সেন্ট্রাল হলে।
স্বাভাবিক ভাবে বিরোধীরা বলছেন, যে কোনও অনুষ্ঠানকে ‘ইভেন্ট’-এ পরিণত করে অন্য মাত্রার প্রচার দিতে মোদীর জুড়ি নেই। জিএসটি-র অনুষ্ঠানও তার ব্যতিক্রম নয়। কাশ্মীরে সুড়ঙ্গপথের উদ্বোধনের ছবিতে তিনি। অসমে সেতুর ফিতে কাটার পরেও তা-ই। তাঁদের মতে, জিএসটি নিয়ে লাগাতার সওয়াল করে গিয়েছে মনমোহন সিংহের ইউপিএ সরকার। বারবার বলেছে তা চালুর কথা। অথচ এখন প্রচারের আলো শুষে নেবেন সেই মোদীই। এক সময় যাবতীয় বিরোধিতা সত্ত্বেও।
মঞ্চ। সংসদের সেন্ট্রাল হল। বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। ৩০ জুন মধ্যরাতে সেখানে ঘণ্টাধ্বনির মাধ্যমে জিএসটি চালুর ঘোষণা করে সম্ভবত ইতিহাসেই ঢুকে পড়তে চাইছেন মোদী। ফাইল চিত্র
শাসক দল অবশ্য বলছে, তা কেন? মঞ্চে তো মনমোহনকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছে সরকার। অনুষ্ঠানে ডেকেছে সমস্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে। জিএসটি চালুর জন্য সমস্ত রাজনৈতিক দলের অবদান স্বীকার করা হচ্ছে মুক্ত কণ্ঠে। কিন্তু বিরোধীরা বলছেন, কৌশল আছে এর পিছনেও। জিএসটি চালু হলে প্রথম দিকে কিছু সমস্যা হতে পারে। প্রাথমিক ভাবে হোঁচট খেতে পারে ব্যবসা-বাণিজ্য। মূল্যবৃদ্ধি মাথাচাড়া দেওয়ার আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তখন বিরোধীরা যাতে সরকারকে দুষতে না-পারেন, হয়তো সেই ব্যবস্থাই করে রাখা হচ্ছে। আমন্ত্রণ জানাতে বাকি রাখা হচ্ছে না অসীম দাশগুপ্ত থেকে শুরু করে এতদিন যাঁরা রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন, তাঁদেরও।
এ দিন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র পেয়ে অবশ্য ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে তৃণমূলের তরফে। তাদের প্রশ্ন, কেন লোকসভা ও রাজ্যসভার নেতাদের আমন্ত্রণ না-পাঠিয়ে, আলাদা ভাবে প্রত্যেক সাংসদকে তা পাঠানো হচ্ছে? সরকারের অবশ্য দাবি, এটি সংসদের অধিবেশন নয়। তাই তেমন প্রথাও এ ক্ষেত্রে নেই।
আয়োজনে আড়ম্বর
•
মধ্যরাতে ঘণ্টা খানেকের অনুষ্ঠান। শুরু রাত ১১টায়। জিএসটি চালু রাত ১২টার ঘণ্টাধ্বনিতে
•
মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সঙ্গে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০১১ সালে জিএসটি-র প্রথম সংবিধান সংশোধনী বিল যে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর হাত ধরে
•
সেখানে থাকবেন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি, লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং এইচ ডি দেবগৌড়া
•
আমন্ত্রিত লোকসভা ও রাজ্যসভার সমস্ত সাংসদ, সব মুখ্যমন্ত্রী, প্রতি রাজ্যের অর্থমন্ত্রী, জিএসটি পরিষদের সমস্ত বর্তমান ও প্রাক্তন সদস্য, চেয়ারম্যান প্রমুখ
•
জেটলির দাবি, কর চালুর পিছনে সমস্ত রাজ্য ও রাজনৈতিক দলের অবদানের ছাপ থাকবে অনুষ্ঠানে
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy