নতুন ট্রেন নেই। নতুন প্রকল্পের শেষ হতে না-চাওয়া তালিকা নেই। তার বদলে রয়েছে বরং আর্থিক ভাবে ‘বেলাইন’ হতে বসা রেলকে লাইনে ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার। ঠিক যে ভাবে ধুঁকতে থাকা, রুগ্ণ কোনও সংস্থাকে ফের চাঙ্গা করে কর্পোরেট দুনিয়া। মোদী-সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ রেল বাজেটে সুরেশ প্রভুর এই কর্পোরেট-ছোঁয়ায় মোটের উপর খুশি শিল্পমহল।
তবে অভিযোগও যে নেই, এমনটা নয়। যেমন, শিল্পমহলের একাংশ মনে করছেন, পণ্য পরিবহণের মাসুল বাড়ায় অসুবিধার মুখে পড়বেন তাঁরা। অনেকের মতে, রেলের আর্থিক স্বাস্থ্য দ্রুত আরও ভাল করার মোক্ষম সুযোগ ফস্কালেন প্রভু। কারণ, জ্বালানির দর এই মুহূর্তে কম। ফলে যাত্রিভাড়া সামান্য কিছুটা বাড়ানোর সাহস দেখাতে পারলেই, ওই খাতে ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারত রেল। সংস্কারের এই সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় এ দিন কিছুটা নিরাশ হয়েছে শেয়ার বাজারও। কিন্তু ইতিউতি এমন কিছু খুচরো অভিযোগ ছাড়া রেলমন্ত্রী প্রভুর বাজেট খুশিই করেছে শিল্পকে।
বণিকসভাগুলি বলছে, রাশি রাশি নতুন ট্রেন-কারখানা-প্রকল্পের কথা ঘোষণাই প্রায় রেওয়াজ হয়ে গিয়েছে রেল বাজেটে। সেখান থেকে সরে এসে আগে ঘর গোছানোর এই চেষ্টায় খুশি শিল্পমহল। এক শিল্পকর্তার মতে, “নুন আনতে পান্তা ফুরনো ঘরে যে লক্ষ টাকার আসবাব কেনার তালিকা বানিয়ে লাভ নেই, তা বুঝেছেন প্রভু। আগে জোর দিয়েছেন রেলের আর্থিক স্বাস্থ্য ফেরানোর উপর। অপারেটিং রেশিও নামিয়ে আনার কথা বলেছেন ৮৮.৫ শতাংশে। আমরা এতে খুশি।”
আর এক শিল্পপতির কথায়, “টাকা কোথা থেকে আসবে, সেই বিষয়টি অন্তত ‘প্রভু’র উপর ছেড়ে দেননি প্রভু। আগামী পাঁচ বছরের লক্ষ্যের কথা যেমন বলেছেন, তেমনই চেষ্টা করেছেন সেই লক্ষ্য ছোঁওয়ার পথ দেখাতেও। শিল্প এমনটাই চায়।” অনেকে আবার বলছেন, ছক ভেঙে এ ভাবে দীর্ঘমেয়াদি ‘রোডম্যাপ’ তৈরির চেষ্টাই খুশি করেছে তাঁদের।
শিল্পমহলের মতে, এই রেল বাজেট বাস্তবের মাটিতে পা রেখে তৈরি। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র বুনটে বাঁধা। তাঁরই স্বচ্ছ ভারতের প্রেরণায় উজ্জীবিত। সরকারের সব যন্ত্র এ ভাবে এক সুরে বাজা পোক্ত প্রশাসনেরই পরিচায়ক।
বণিকসভাগুলি খুশি, কারণ নিছক প্রকল্প ঘোষণা নয়, বরং প্রকল্প রূপায়ণে জোর দিয়েছেন প্রভু। এতে সংস্থা পরিচালনায় দক্ষতার ছাপ খুঁজে পাচ্ছে তারা। সিআইআই-এর ডিরেক্টর জেনারেল চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ব্যবসায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে যে ভাবে লক্ষ্য স্থির করা হয়, তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বাজেটে। আগামী দিনে রেলের উন্নতি-পরিকল্পনায় যে ভাবে রাজ্যগুলিকে সামিল করার কথা বলা হয়েছে, তারও প্রশংসা করেছেন তিনি। অ্যাসোচ্যামের প্রেসিডেন্ট রানা কপূর আবার মনে করছেন, স্টেশনের আধুনিকীকরণ থেকে শুরু করে পণ্য পরিবহণ আগামী দিনে সব ক্ষেত্রেই রেলকে দক্ষ করে তুলতে বড়সড় ভূমিকা নেবে বেসরকারি ক্ষেত্র। ইইপিসি-র চেয়ারম্যান অনুপম শাহের আশা, যাত্রী ও পণ্য পরিবহণে গতি বাড়লে, সহজ হবে ব্যবসা করা।
ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অব কমার্স (আইসিসি) মনে করছে, প্রভুর প্রতিশ্রুতি মেনে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রেল-সংযোগ বাড়লে, বাস্তবায়িত হবে সেখানকার উন্নয়ন সম্ভাবনা। বেঙ্গল চেম্বারের ডিরেক্টর জেনারেল পি রায়ের মতে, এই বাজেট গঠনমুখী ও স্বচ্ছ। এমসিসি চেম্বারের প্রেসিডেন্ট অরুণ সরাফ বলছেন, প্রকল্প রূপায়ণে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের যোগদান নিশ্চিত করার বন্দোবস্ত রয়েছে বাজেটে।
কিন্তু প্রশস্তির পাশাপাশি প্রশ্নের কাঁটাও বিছিয়ে রাখছে শিল্পমহল। যেমন, সরাফেরই আশঙ্কা, পণ্য মাসুল বৃদ্ধির জেরে ধাক্কা খেতে পারে উৎপাদন শিল্পকে চাঙ্গা করার চেষ্টা। আইসিসি-র প্রশ্ন, পাঁচ বছরে প্রস্তাব রূপায়ণে বিপুল লগ্নি কোথা থেকে জোগাড় করবেন প্রভু? কারও আবার আশঙ্কা, তা করতে গিয়ে দেনার দায়ে হাঁসফাঁস করবে না তো রেল?
শিল্পমহলেরই আর এক অংশ অবশ্য বলছেন, সেই সম্ভাবনা এড়াতেই লগ্নি টানতে স্পেশাল পারপাস ভেহিক্ল (এসপিভি) গড়ার কথা বলেছেন প্রভু। যেখানে রেল টাকা ঢালবে, কিন্তু অংশীদারির ভিত্তিতে। ফলে সব টাকা জোগাড় করার দায় বর্তাবে না তাদের উপর। চাপ পড়বে না আর্থিক স্বাস্থ্যেও। নতুন প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি না দিয়ে, পুরনোগুলি শেষ করার দিকে নজর দেওয়ায় আশান্বিত বিএনসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট এ কে সরকার। শ্রেয়ী ইনফ্রাস্ট্রাকচার্সের হেমন্ত কানোরিয়াও প্রশংসা করছেন বাস্তবমুখী বাজেটের। এই বাজেটকে দীর্ঘমেয়াদি সনদ হিসেবে দেখছে ছোট শিল্পের দুই সংগঠন ফ্যাকসি এবং ফসমিও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy