গত কয়েক দশক ধরেই বাঙালি ডাকঘরকে বেছে নিয়েছে টাকা রাখার অন্যতম সুরক্ষিত জায়গা হিসেবে। সুরক্ষার পাশাপাশি ভাল আয়ের সুবাদে ডাকঘর ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয়। পছন্দের অন্য কারণগুলি হল নগদে টাকা রাখা এবং তোলার সুবিধা, গ্রামেগঞ্জে ও প্রত্যেক অঞ্চলে ডাকঘরের উপস্থিতি, মাসিক আয়ের সুবিধাযুক্ত প্রকল্প, কর সাশ্রয়কারী প্রকল্প, বেশির ভাগ প্রকল্পে উৎসমূলে কর না-কাটা, করমুক্ত প্রকল্প এবং ডাকঘর-কর্মী ও এজেন্টদের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক। এই সব কারণে ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পে টাকা জমা রাখার ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই প্রথম সারিতে। প্রবীণ নাগরিকদের কাছে ডাকঘর এত কাল মন্দিরের মর্যাদা পেয়ে এসেছে।
এই নিবিড় সম্পর্কে কিন্তু এ বার কিছুটা হলেও চিড় ধরতে শুরু করেছে। ১ এপ্রিল থেকে সুদ কমানো হয়েছে প্রায় প্রতিটি প্রকল্পে। একটি নির্দিষ্ট সীমার উপরে নগদে টাকা জমা রাখা ও তোলা বন্ধ হয়েছে। শুরু হয়েছে কেওয়াইসির কড়াকড়ি। এমনিতে সঞ্চয়কারীর সংখ্যা বহু গুণ বাড়া সত্ত্বেও পরিষেবা তেমন উন্নত হয়নি। যে-কারণে নতুন প্রজন্ম কিছুটা এড়িয়ে চলে ডাকঘরের পথ। তবে সুদ বাবদ কিছু অতিরিক্ত প্রাপ্তির কারণে সাধারণ মানুষ ডাকঘরেই বাসা বেঁধেছিলেন। সুদ কমতে শুরু করায় সে সম্পর্কটাও ফিকে হয়ে আসবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
যদিও মন দিয়ে নজর করলে দেখা যাবে, এখনও ডাকঘর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার সময় আসেনি। আয় কিছুটা কমলেও এখনও প্রকল্পগুলি ব্যাঙ্ক-জমার তুলনায় এগিয়ে আছে। রয়েছে করছাড়ের সুবিধা। আর সুরক্ষার ব্যাপারে তো কোনও কথাই নেই। গ্রামগঞ্জের মানুষ, যাঁদের অনেকেই লোক ঠকানো প্রকল্পে টাকা রেখে হাত পুড়িয়েছেন, তাঁরা অবশেষে বুঝেছেন অশোকস্তম্ভ মার্কা সুরক্ষার মাহাত্ম্য। এক নজরে দেখে নেব সুদ কমার পরে জনপ্রিয় ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পগুলির বর্তমান অবস্থা।
ডাকঘর মাসিক আয় প্রকল্প: স্থির মাসিক আয়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জায়গা বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত নাগরিকদের জন্য। সুদ কমে ৭.৮% হলেও বর্তমান বাজারে আকর্ষণীয়। আয় করযোগ্য। মেয়াদ ৫ বছর। সর্বাধিক জমা একক নামে ৪.৫ লক্ষ, যুগ্ম নামে ৯ লক্ষ টাকা।
পিপিএফ: সুদ কমে ৮.১% হলেও উঁচু হারে আয়করদাতাদের কাছে এখনও এটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকল্প। মনে রাখতে হবে, ব্যাঙ্কে করযোগ্য মেয়াদি আমানতে সুদ এখনও পিপিএফ থেকে কম। যাঁরা ৩০ এবং ২০% করের আওতায় পড়েন ৮.১ শতাংশের সঙ্গে কর যোগ করা হলে তা করযোগ্য যথাক্রমে ১১.৫৭% এবং ১০.১৩ শতাংশের সমান, যা পড়তি সুদের বাজারে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এ ছাড়া এখানে জমার উপর পাওয়া যায় ৮০সি ধারায় করছাড়ের সুযোগ। ১৫ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পে বছরে সর্বাধিক ১.৫ লক্ষ জমা করা যায়।
প্রবীণ নাগরিক প্রকল্প: সুদ কমে ৮.৬% হলেও ব্যাঙ্ক-জমার চেয়ে আকর্ষণীয়। আছে ৮০সি ধারায় কর ছাড়ের সুবিধাও। সর্বাধিক ১৫ লক্ষ রাখা যায় ৫ বছর মেয়াদে। সুদ ৩ মাস অন্তর। উপযুক্ত ক্ষেত্রে উৎসে কর কাটা হয়।
কিসান বিকাশ পত্র: সুদ কমে ৭.৮% হওয়ায় কিছুটা আকর্ষণ কমতে পারে এই প্রকল্পের। আগে সুদ ছিল ৮.৭%।
সুকন্যা সমৃদ্ধি প্রকল্প: ৯.২% থেকে সুদ ৮.৬% হলেও বর্তমান বাজারে আকর্ষণ তেমন কমা উচিত নয়।
এন এস সি: ৫ বছর মেয়াদি কর সাশ্রয়কারী এই প্রকল্পে সুদ ৮.১%। কর সাশ্রয়কারী ব্যাঙ্ক-জমার তুলনায় ভাল।
মেয়াদি আমানত: ৫ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পে সুদ কমে হয়েছে ৭.৯%। অতিরিক্ত আকর্ষণ তেমন নেই।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সুদ কমার পরেও বেশির ভাগ প্রকল্পের আকর্ষণ তেমন কমার কথা নয়। সমস্যা হবে সুদ যদি আরও কমে। পরিষেবা নিয়ে ডাকঘরে সমস্যা তো আছেই। কর্মীও কম। ফলে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয় ‘মাস্টারমশাই’দের। বহু ক্ষেত্রেই কাজ তুলতে হয় এজেন্টদের সাহায্যে। পুরো ব্যাপারটি চলে ডাকঘর, গ্রাহক এবং এজেন্টদের মধ্যে সহযোগিতায় ভর করে। গড়ে ওঠে এক নিবিড় সম্পর্ক। এই ভাবে পোস্টমাস্টার হয়ে ওঠেন অতি সম্মানীয় ব্যক্তি। সমস্যা বেড়েছে এজেন্টদেরও। বিভিন্ন প্রকল্পে কমিশন কমেছে। জমা কমলে গভীর সমস্যায় পড়বেন এঁরা, যাঁদের সংখ্যা খুব কম নয়।
সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও বিভিন্ন কারণে ডাকঘর হয়ে উঠেছে একটি সুন্দর সামাজিক সম্পর্ক গড়ার মাধ্যম। গ্রাহকরাই যদি মুখ ফেরান, তবে হয়তো ভবিষ্যতে ইতিহাসের পাতায় চলে যাবে আমাদের অতি প্রিয় ডাকঘর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy