দেওয়াল লিখন স্পষ্ট হচ্ছিল বেশ ক’বছর ধরেই। ব্যবসা বিক্রির ঘোষণা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সময়ের অপেক্ষা। শেষ পর্যন্ত সব জল্পনায় দাঁড়ি টেনে বিক্রিই হয়ে যাচ্ছে ইয়াহু।
সোমবার ৪৮৩ কোটি ডলারে (৩২,৩৬১ কোটি টাকা) ইয়াহুর মূল ইন্টারনেট ব্যবসা কিনে নেওয়ার কথা ঘোষণা করল আর এক মার্কিন সংস্থা ভেরিজোন কমিউনিকেশন্স। যাকে নেট-দুনিয়ায় আস্ত যুগের অবসান হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন অনেকে।
ইয়াহু জানিয়েছে, ভেরিজোনকে শুধু নেট ব্যবসাই বিক্রি করছে তারা। অর্থাৎ, চিনা ই-কমার্স সংস্থা আলিবাবা-র ১৫% অংশীদারি, ইয়াহু-জাপানের শেয়ার সমেত বিভিন্ন এশীয় লগ্নি থাকছে নিজেদের জিম্মাতেই। শেয়ার দরের নিরিখে যার মোট মূল্য ৪,০০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ, আর নেট-পরিষেবা সংস্থা হিসেবে নয়, নিখাদ লগ্নি সংস্থা হিসেবে ব্যবসা করবে ইয়াহু। এই হাতবদলে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষ ও নিয়ন্ত্রকের সায় পাওয়া অবশ্য বাকি।
তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়া বলছে, এই হাতবদলে চমক নেই। কিন্তু স্মৃতিমেদুরতা বা নস্টালজিয়া আছে পুরো মাত্রায়। কারণ, ভারত-সহ সারা পৃথিবীতে ইন্টারনেটের সঙ্গে বহু জনের পরিচয় এই সংস্থার হাত ধরে। অনেকেরই নিজের প্রথম ই মেল-আইডি ইয়াহুর খাতায় খোলা। শেয়ার দরের ভিত্তিতে ২০০০ সালে এই সংস্থার মোট বাজারমূল্য ছিল ১২,৫০০ কোটি ডলার। দেড় দশকের মধ্যে এ হেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ সংস্থার এ ভাবে নটে গাছ মুড়োনো যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, নেট-দুনিয়ার প্রতিযোগিতা কত নির্মম।
১৯৯৪ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই পড়ুয়ার হাতে ইয়াহুর গোড়াপত্তন। সংস্থা হিসেবে পথ চলা শুরু ১৯৯৫ সালে। মাঝের এই লম্বা সময়ে বারবার নিজেদের ব্যবসা কৌশল পাল্টানোর চেষ্টা করেছে তারা। নেটে ওয়েবসাইট খুঁজে বার করতে ‘সার্চ’-এর তারা অন্যতম পথিকৃৎ। নিখরচার ই-মেলে যোগাযোগের রাস্তা খুলে দেওয়ার ক্ষেত্রেও তারা অন্যতম অগ্রণী সংস্থা। এক সময় যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল তাদের ‘মেসেঞ্জার’ পরিষেবা। ওয়েবসাইটে কমতি নেই খবর-বিনোদনেরও। এখনও সারা বিশ্বে প্রতি মাসে ইয়াহুর পরিষেবা ব্যবহার করেন অন্তত ১০০ কোটি জন। ৬০ কোটিই মোবাইলে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঠিক এই কারণেই ইয়াহুর ‘পড়ন্ত’ ব্যবসার পিছনেও ৪৮৩ কোটি ডলার উপুড় করতে তৈরি ভেরিজোন। মোবাইল ও নেট পরিষেবা সংস্থাটির লক্ষ্য, আরও অনেক বেশি গ্রাহকের দরজায় পৌঁছে যাওয়া। তাদের আরও বেশি পড়া ও বিনোদনের খোরাক (কনটেন্ট) জোগানো। সেই কারণে গত বছর প্রায় ৪৪০ কোটি ডলারে এওএল-কে কেনে তারা। এ বার নিশানা ইয়াহু।
কিন্তু পড়তি বাজারেও যে সংস্থার দরজায় মাসে ১০০ কোটি ব্যবহারকারীর ভিড়, তাদের পিঠ এ ভাবে দেওয়ালে ঠেকল কী ভাবে?
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, এর কারণ মূলত দু’টি—
(১) গত দেড় দশকে বহু রকম ব্যবসায় হাত বাড়িয়েছে ইয়াহু। কিন্তু কোনওটিতেই স্বাতন্ত্র্যের ছাপ সে ভাবে রাখতে পারেনি। তৈরি করতে পারেনি এমন কোনও পণ্য বা পরিষেবা, যার সঙ্গে একাত্ম করে ফেলা যায় ইয়াহু ব্র্যান্ডকে। নেটে তথ্য খোঁজা বা সার্চে যেমন অ্যালফাবেটের গুগ্ল, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ে যেমন ফেসবুক, তেমন এক ডাকে চেনা ব্র্যান্ড ইয়াহুর ঝুলিতে কোথায়? কিছুটা ব্যতিক্রম ফ্লিকআর।
(২) ই-মেল থেকে শুরু করে কনটেন্ট— ইয়াহুর প্রায় কোনও পরিষেবাতেই টাকা গুনতে হয় না গ্রাহকদের। সংস্থার আয় মূলত অনলাইন বিজ্ঞাপন থেকে। কিন্তু গত দেড় দশকে তাদের পায়ের তলা থেকে সেই মাটি অনেকটাই কেড়ে নিয়েছে বিভিন্ন সংস্থা। বিশেষত গুগ্ল এবং ফেসবুক। এক সময় যে দুই সংস্থাকে কিনতে চেষ্টা করেছিল ইয়াহু।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই জন্যই বারবার চেষ্টা করেও টিকল না ইয়াহুর নেট ব্যবসা। লাভ হল না চার বছর আগে বিপুল খরচে কর্ণধার হিসেবে মারিসা মায়েরকে এনেও। এ দিন মায়েরের দাবি, ‘‘ইয়াহু দুনিয়া বদলেছে। এবং আগামী দিনেও তা-ই করবে ভেরিজোন এবং এওএলের সঙ্গে মিলে।’’ সত্যি?
উত্তর সময়ের গর্ভে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy