Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
এম আর বাঙুর

আবির-রঙে পাল্টে গেল ঘরছাড়াদের ঘর

বিকেলের রংটা পাল্টে গেল আচমকাই! সেই রোজকার মতোই ব্যাগ গুছিয়ে ‘আমি এখনই চলে যাব’ বলে তাঁর কাল্পনিক বাড়ির খোয়াবে বিভোর ছিলেন চুল বেঁধে ফিটফাট প্রৌঢ়া ‘সুন্দরী মা’। আর দিদি-জামাইবাবুর বাড়িতে নির্যাতিতা অষ্টাদশী চুমকির সঙ্গে পায়ে পা তুলে ঝগড়ায় ব্যস্ত ‘মুন্নি’!

দোলের উচ্ছ্বাস। বৃহস্পতিবার, হাসপাতালের ওয়ার্ডে। ছবি; স্বাতী ভট্টাচার্য।

দোলের উচ্ছ্বাস। বৃহস্পতিবার, হাসপাতালের ওয়ার্ডে। ছবি; স্বাতী ভট্টাচার্য।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৫ ০১:৪৩
Share: Save:

বিকেলের রংটা পাল্টে গেল আচমকাই!

সেই রোজকার মতোই ব্যাগ গুছিয়ে ‘আমি এখনই চলে যাব’ বলে তাঁর কাল্পনিক বাড়ির খোয়াবে বিভোর ছিলেন চুল বেঁধে ফিটফাট প্রৌঢ়া ‘সুন্দরী মা’। আর দিদি-জামাইবাবুর বাড়িতে নির্যাতিতা অষ্টাদশী চুমকির সঙ্গে পায়ে পা তুলে ঝগড়ায় ব্যস্ত ‘মুন্নি’!

যৌন হিংসার শিকার একদা ফুটপাথবাসিনী মুন্নির মধ্যে রাগটা একটু বেশিই। সুরের আবির ছিটকে এসে সেই রাগে জল ঢেলে দিল। নৃত্যপটিয়সী বৃদ্ধা ‘হেলেন’ চলে এসেছেন ঘরের মাঝখানে। কোমর দুলিয়ে শুরু করেছেন ‘হোলি কে দিন দিল খিল জাতে হ্যায়..’! সত্যিকারের গোলাপি আবিরের কয়েক মুঠোও ছুড়ে দেওয়া হল। আর তাতেই পুরোপুরি পাল্টে গেল আবহ।

স্থান: এম আর বাঙুর হাসপাতাল। ঘরছাড়াদের ওয়ার্ড। পুলিশের হাতে ‘উদ্ধার’ সাত কুলে কেউ নেই-দের সঙ্গে যেখানে থাকেন মানসিক ভাবে ভারসাম্যহীন বা পরিবারের কাছে পরিত্যক্ত কিংবা কোনও না কোনও যৌন অত্যাচারের শিকার কয়েক জন ভারত-কন্যা! বৃহস্পতিবার দোলের দুপুরে কয়েক মুহূর্তের জন্য দগদগে বাস্তবটা যাঁদের কাছে অবান্তর হয়ে গেল।

রোগীকল্যাণ সমিতির সভাপতি তথা মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের নির্দেশ, পুলিশ মারফত হাজির নর-নারীদের যত দূর সম্ভব শুশ্রূষা, আদর পৌঁছে দিতে হবে। হাসপাতালের সুপার সোমনাথ মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে কর্মীরা সকলেই এই অভাগা সহ-নাগরিকদের দোল রঙিন করে তুললেন।

ভালবাসার মন থাকলেই কিন্তু অনেকটা হয়। হাসপাতালের সব কর্মী মিলে ১০ টাকা করে চাঁদা দিয়েছেন। তাতেই এলাহি আয়োজন! লুচি, কাশ্মীরি আলুর দম, মুরগির মাংস ও মালপোয়া। সুপারসাহেব আর হাসপাতালের ‘দিদি’দের সঙ্গে দোল খেলার পরে হই হই করে সক্কলে খেতে বসলেন।

শিয়ালদহ স্টেশন থেকে উদ্ধার গণধর্ষণের শিকার হিন্দিভাষী মেয়েটি বাহারি দুলে সেজেছেন। এখন আর দাঁড়াতে পারেন না। তবে ঘষটে ঘষটে এগিয়ে সবার মধ্যিখানে খেতে বসলেন। জীবনে প্রথমবার মালপোয়া চেখে অভিভূত ‘কী বলে রে এইটেকে, কী বললি পোহা... পোহা’ বলে দিদিদের অস্থির করে তুলছেন। ভাজাভুজি খাওয়া অভ্যেস নেই, যদি কিছু হয় ভেবে আগাম সবাইকে গ্যাসের ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়েছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার সেবন্তী মুখোপাধ্যায়। মেয়েদের ‘পুরি দে, পুরি দে’ আবদারে সবাই অস্থির হয়ে পড়লেন।

খুশির রং ছড়িয়ে পড়েছিল পাশের পুরুষদের ওয়ার্ডেও। কানহা, ‘ল্যাংড়া জগদীশ’, রাম সুপারস্যারের পরানো আবিরের টিপ কপালে গোগ্রাসে লুচি খেলেন। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, মোট ৫২ জনের মধ্যে ৪৪ জনই মহিলা। ছেলেরা সুস্থ হলে নিজেরাই চলে যান পথের ঠিকানাহীন ঠিকানায়। কিন্তু মেয়েদের তো ছাড়া যায় না! রাজ্যে হোমের সংখ্যাও অপ্রতুল। তাই মেয়েরাই এই ওয়ার্ডের চিরকালীন আবাসিক।

পরিবারের কাছে বাতিল এইচআইভি পজিটিভ এক নারী এই সংসারের কর্ত্রী। সব ঝগড়া, হুটোপাটি সামলান তিনিই। ঘরহারাদের দুষ্টুমিতে আকছার দেওয়াল, মেঝে ময়লায় মাখামাখি হচ্ছে। ফিনাইলের ঢালাও প্রয়োগ সেই দুর্গন্ধ পুরোটা চাপা দিতে পারে না। নার্স আরতিদি, তাপসীদি, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার শম্পা-রা মিলে দুষ্টু মেয়েদের চান করাতে হিমশিম খান। উকুনের সঙ্গে অসমযুদ্ধে আবাসিকদের ঘন-ঘন চুল কাটানো হয়। হাসপাতালের ‘দিদি’রাও দফায় দফায় উকুনের খপ্পরে পড়েন। সেবন্তী বলছিলেন, “সামান্য লোকবল নিয়েই ভাল রাখার যুদ্ধ চলছে।”

মেয়েদের কেউ কেউ রঙিন চুলে সেজে নিলেন। নার্সদের সাদা উর্দি রঙে রঙে রাঙা হল। সুপার পর্যন্ত আবির মেখে ভূত। রঙিন ধুলো, গানের সুর আর লুচির গন্ধে ঘরছাড়াদের ঘরটাই তখন হাসপাতালের ‘ভিআইপি ওয়ার্ড’।

(আবাসিকদের কয়েকটি নাম পরিবর্তিত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

m r bangur hospital wriju basu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE