বাবা-ঠাকুর্দা নামজাদা মৃৎশিল্পী। ছেলেমেয়ের শিল্পকর্মে সময় নেই। কেউ চাকরি নিয়েছেন বেসরকারি সংস্থায়। কেউ প্রস্তুতি নিচ্ছেন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার। ভবিষ্যতের চিন্তায় কপালে ভাঁজ কুমোরটুলির শিল্পীদের।
তিন পুরুষ ধরে প্রতিমা তৈরি করছেন অপূর্ব পাল। কুমোরটুলি প্রগতিশীল মৃৎশিল্পী ও সাজশিল্পী সমিতির সম্পাদক অপূর্ববাবু প্রকাশ্যেই স্বীকার করেন, ‘‘আমরা দু’ভাই ছেলেবেলা থেকে বাবা-ঠাকুর্দার কাজ দেখে বড় হয়েছি। কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েরা এই পেশায় থাকবে না।’’
অপূর্ববাবু স্বীকার করলেও খোলা গলায় তা জানাতে রাজি নন কুমোরটুলির দুই শিল্পী। ওঁদের একজনের ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে কাজ পেয়েছেন সেক্টর ফাইভে একটি নামী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায়। তিন পুরুষ ধরে কুমোরটুলিতে স্বীকৃত ওই শিল্পীর আর্জি, ‘‘আমার আর ছেলের নাম লিখবেন না। তাতে সামাজিক সমস্যা হতে পারে। ছেলে অবশ্য ছুটির দিনে আমাকে প্রতিমা তৈরির কাজে সাহায্য করার চেষ্টা করে।’’ অপর এক প্রতিমাশিল্পীর মেয়ে কাজ পেয়েছেন ব্যাঙ্কে। ওঁরাও প্রকাশ্যে ওঁদের নাম আনতে রাজি নন।
কুমোরটুলি সংস্কৃতি সমিতির কর্মকর্তা মিন্টু পালের বক্তব্য, ‘‘নিয়মিত আয়, অবসরকালীন সুযোগ এবং যথেষ্ট সামাজিক মর্যাদা না থাকায় মৃৎশিল্পীদের অনেকে হীনমন্যতায় ভোগেন। ওঁদের ছেলেমেয়েরা অনেকে পড়াশোনা শিখে বিভিন্ন আধুনিক পেশায় কাজের সুযোগ পাচ্ছেন।’’
কুমোরটুলিতে প্রতিমাশিল্পীর সংখ্যা প্রায় ৩৫০। যাঁরা একটু প্রতিষ্ঠিত, প্রতি বছর ৪০-৫০টি দুর্গাপ্রতিমা তৈরির বরাত নেন। অধিকাংশেরই স্ত্রী-পুত্র-কন্যা হাত লাগান শিল্পকর্মে। এটাই চিরকালীন রীতি। এখন প্রতি পরিবারে সদস্য কমে গিয়েছে। নির্ভর করতে হচ্ছে ভাড়া করা সহায়ক-শিল্পীদের উপর। অপূর্ববাবু বলেন, ‘‘সমস্যা হচ্ছে, এ রকম সহায়কের আকাল দেখা দিয়েছে। প্রতি বছর ছ’জন সহায়ক শিল্পী থাকে আমার। এ বার একজন কম নিয়েই কাজ চালাতে হচ্ছে।’’
ঠাকুরের কাঠামোয় মাটির তাল লেপার পর পর্যায়ক্রমে হাতের ছোঁয়ায় রূপদান— এ সবে দরকার সহায়কদের। তদারকি, সর্বাঙ্গসুন্দর করার কাজটা মূল শিল্পীদের। সহায়করা কুমোরটুলিতে আসেন মূলত জেলা থেকে। থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব নিতে হয় মূল শিল্পীদের। যাঁরা একেবারে আনকোরা, তাঁরা মূলত ১৮ থেকে ২২ বছর বয়সী। সকাল ৮টা থেকে ১টা, বেলা ৩টে থেকে ৮টা— মোট ১০ ঘন্টা কাজ করেন তাঁরা। কমবেশি হাজার তিন টাকা হাতখরচ পান। দক্ষ ও অভিজ্ঞ সহায়কদের পারিশ্রমিক আরও বেশি। এই সব সহায়কদের সিংহভাগ আগে আসতেন নদিয়া থেকে। এখন কুমোরটুলিতে নদিয়ার সহায়ক কমেছে, বেড়েছে মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়ার সহায়ক।
শিল্পী স্বপন কুমার পাল বলেন, ‘‘কুমোরটুলিতে সহায়ক আসার অন্যতম প্রধান কারণ গ্রামবাংলার বন্যা।’’ মিন্টু পালের বক্তব্য, সরকারি নানা প্রকল্পে কাজের সুযোগ বেড়েছে। গ্রামের শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা এখন আর কুমোরটুলিমুখো হতে আগ্রহী নন।’’
জীবনধারার অভিমুখ বদলে যাচ্ছে। শঙ্কা তাই কুমোরটুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy