Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
চারু অ্যাভিনিউ

খোঁড়া রাস্তা সারাই হতে আঠারো মাস

দু’ধারে গাছের সারি, মাঝ বরাবর চওড়া রাস্তা। অ্যাভিনিউ মানে তো তাই। চারু অ্যাভিনিউ তবে কী? দু’পাশে গাছ দূরে থাক, এক চিলতে গলিটায় ফুটপাথই তো নেই। তবে সবুজ আছে। অনেকখানি। বাড়িতে-বাড়িতে বারান্দা, জানলার তাক গাছে ঘেরা। আরও আছে। এ পাড়ার মানুষগুলোর মনে।

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

দেবাশিস রায়
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৪৯
Share: Save:

দু’ধারে গাছের সারি, মাঝ বরাবর চওড়া রাস্তা। অ্যাভিনিউ মানে তো তাই। চারু অ্যাভিনিউ তবে কী? দু’পাশে গাছ দূরে থাক, এক চিলতে গলিটায় ফুটপাথই তো নেই। তবে সবুজ আছে। অনেকখানি। বাড়িতে-বাড়িতে বারান্দা, জানলার তাক গাছে ঘেরা। আরও আছে। এ পাড়ার মানুষগুলোর মনে। এভারগ্রিন যাকে বলে। সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে দেখে আসছি। এখনও একেবারে একই রকম। এটাই আমার পাড়া।

জন্ম ইস্তক এ পাড়াতেই। ৫৬ বছরে অনেক কিছু বদলে গিয়েছে। কিছু ভাল, কিছু খারাপ। তবে যেটা একেবারে বদলায়নি, তা হল পাড়া-পড়শিদের মধ্যে সম্পর্কের অটুট বাঁধন। রাতবিরেতে যে কোনও দরকারে, বিপদে-আপদে বরাবরই আত্মীয়দের আগে পৌঁছে গিয়েছেন পাড়ার মানুষেরা। বাড়ির লোকেরা এসে পৌঁছনোর আগে পাশে পেয়েছি তাঁদের। সে ডাক্তার-বদ্যির ব্যবস্থা হোক বা অন্য যে কোনও প্রয়োজন। ছোটবেলায় দুষ্টুমি করে শুধু যে বাড়িতে বকুনি খেয়েছি, তা তো নয়। দরকার মনে করলে নির্দ্বিধায় বকাঝকা করেছেন কালীদাস রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, পদ্মাদেবীর মতো বিশিষ্টরাও। নিজেরাই বাবাকে জানিয়ে গিয়েছেন। এঁদের কাছ থেকে যে স্নেহ, ভালবাসা পেয়েছি তা ভোলার নয়। এত বছরেও সে চরিত্র বদলায়নি। আজও এ পাড়ায় বল-ভরসা পড়শিরাই। এমনকী বাড়ি খালি রেখে বেড়াতে গেলেও ওঁদেরই তো খেয়াল রাখার ভার দিয়ে যাই নিশ্চিন্তে। সেই সঙ্গেই মহিলাদের সুরক্ষার দিকটার কথাও বলা উচিত। গত ৫৬ বছর ধরে এখনও এ পাড়া খুব নিরাপদ। রাত ১১-১২টাতেও নিশ্চিন্তে চলাফেরা করতে পারে মেয়েরা। নিরিবিলি পাড়ায় গোলমালও নেই কোনও দিনই। চুরি-ডাকাতির মতো অপরাধও হয় না বললেই চলে।

পরিবর্তনের তালিকায় প্রথম বোধহয় গঙ্গার উপরে কাঠের ব্রিজটার ভোলবদল। পায়ে চলা সেই ব্রিজ এখন কংক্রিটের, অনেকটা চওড়া। গাড়িঘোড়া চলে। ফলে এ পাড়া থেকে নিউ আলিপুরে যাতায়াত এখন অনেক সহজ। যোগাযোগ বেড়ে গিয়েছে অনেকখানি। সেই সঙ্গে রাস্তাঘাট এখন বেশ সাফসুতরো থাকে। আগে যেমন ২৪ ঘণ্টায় এক বারই সাফাই হত, সেখানে এখন দিনে দু’তিন বার আসে পুরসভার জঞ্জালের গাড়ি। পুরনো টিমটিমে আলোর জায়গায় এখন ঝলমলে ভেপার লাইট। জল জমার সমস্যাটাও একেবারে চলে গিয়েছে। বছর চোদ্দো আগেও সামনের গলির মুখে এক কোমর জল দাঁড়াত। এ সবেরই কৃতিত্ব আমাদের কাউন্সিলর জুঁই বিশ্বাসের।

তবে আমাদের বাড়ির পিছন দিকটায় একটা খেলার মাঠ ছিল। পুকুর বুজিয়ে তৈরি করা সেই মাঠে বিকেল হলেই তুমুল খেলাধুলো। সেই মাঠের জায়গাতেই এখন গাড়ির কারখানা। ছেলেমেয়েগুলো খেলবে কোথায়? একটা পার্ক হয়েছে অবশ্য। ইঁদুরদৌড়ে ছুটে চলা এখনকার ছেলেমেয়েরা দৌড়ঝাঁপ করে খেলেই বা কই! আমাদের ছোটবেলার গুলি, লাট্টু, ঘুড়িও তো হারিয়েই গিয়েছে।

এই জায়গার অভাবেই আর একটা জিনিসও বন্ধ হয়ে গেল। এ পাড়ায় আগে গুণিজন সংবর্ধনার একটা অনুষ্ঠান হত। সে পাট চুকে গিয়েছে। আসলে পাড়ার একটা কমিউনিটি হল দরকার। এ ধরনের অনুষ্ঠানও হতে পারে, আবার বিয়ে বা বাড়ির অন্য অনুষ্ঠানগুলোও। আসলে সংস্কৃতির সঙ্গে এ পাড়া বরাবরই ওতপ্রোত জড়িয়ে। প্রতি বছর পুজোয় বড় ফাংশন, নাচ-গান, দলবেঁধে নাটক— সেই ছোটবেলা থেকে এ সবের মধ্যেই বেড়ে ওঠা। বড় হওয়ার পরে অনেকেই ছড়িয়েছিটিয়ে গিয়েছে, তাই পুজোর ফাংশনও এখন বছর দুয়েক অন্তর হয়। তবে পাড়ায় মহিলা সমিতি অবশ্য নিয়মিত কিছু অনুষ্ঠান করেন। রবীন্দ্রজয়ন্তী হয়। এখনও পাড়ার বাচ্চারা নাচ-গান-আবৃত্তিতে অংশ নেয়। হ্যাঁ, আগের চেয়ে অনেক কম বটে, তবে অন্য অনেক পাড়ার চেয়ে বেশি। নিয়ম করে রক্তদান শিবির ও বসে আঁকো প্রতিযোগিতাও হয় প্রতি বছর। আর আছে একটা ওয়াল ম্যাগাজিন। তুমুল উৎসাহে লেখালেখি চলে।

কিন্তু সবই কি আর ভাল?

রাত বাড়লেই প্রবল গতিতে মোটরবাইক ছোটে এই গলি দিয়ে। প্রতিটাতে অন্তত দু’তিন জন, হেলমেটহীন। সাইলেন্সার খোলা বাইকে রাতের নিস্তব্ধতা নিমেষে খান খান। পুলিশকে বলা হয়েছিল। তাতে টহলদারি বেড়েছে শুধু। দৌরাত্ম্য থেকে মুক্তি জোটেনি নিরিবিলি পাড়াটার।

এ পাড়াটা তো বহু দিনের। তাই চতুর্দিকে একটা পুরনো গন্ধ ঘিরে রাখত এই তো ক’বছর আগেও। পুরনো বাড়িগুলো সব ভেঙেচুরে বহুতল উঠছে একের পর এক। পাড়ার রাস্তায় সেই সেকেলে গন্ধটাও হারিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। এটা কিন্তু আমাদের মতো পুরনো বাসিন্দাদের কাছে বেশ দুঃখের।

আর রাস্তা খুঁড়লে যদি একটু তাড়াতাড়ি বুজিয়ে ফেলার ব্যবস্থা হত। এক বার খোঁড়া মানে কবে যে তা সারবে, সেই অপেক্ষায় দিন গোনা ছাড়া উপায় থাকে না। সেই সঙ্গেই একটু ফুটপাথের ব্যবস্থা হোক না এ পাড়ায়। চারু অ্যাভিনিউ সত্যিই অ্যাভিনিউ হয়ে উঠতে পারে তো!

লেখক বিশিষ্ট আইনজীবী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE