হেদুয়ায় ৬৩ বছর হয়ে গেল। জন্ম থেকে এখানেই বাস। পড়াশোনা স্কটিশে। এ পাড়ার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেকটা শরীরের সঙ্গে আত্মার মতোই। এই চৌহদ্দিতে রয়েছে বেথুন, সেন্ট মার্গারেট, হোলি চাইল্ড, ভবতারণ সরকার, স্কটিশচার্চের মতো একাধিক স্কুল ও কলেজ। তাই রং-বেরঙের ইউনিফর্ম পরা এক ঝাঁক পড়ুয়া এ পাড়ায় নিত্য দাপিয়ে বেড়ায়। রয়েছে ডাফ চার্চ, ক্রাইস্ট চার্চ। আছে ডাফস্ট্রিট, গোয়াবাগান স্ট্রিট, রামদুলাল সরকার স্ট্রিট, বিডন স্ট্রিটের অংশ। আজও এর অলিতে গলিতে ফুটবল চলে জোরকদমে।
অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের বাবা পশুপতিচরণ বিশ্বাসের থেকে ১৯২৫-এ বাড়িটি কিনে নেন আমার ঠাকুর্দা। সেই থেকে ঠিকানা, ‘ভোলানাথ ধাম’। অনেক নামজাদা লোকের বাস ছিল এ পাড়ায়। থাকতেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আন্তর্জাতিক ট্রায়ালের বিচারক রাধাবিনোদ পাল। ছিলেন ইংরেজি গ্রামার বইয়ের লেখক প্যারিচরণ সরকার, রেডিওলজিস্ট শম্ভু মুখোপাধ্যায়, শল্যচিকিৎসক পঞ্চানন চট্টোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তি। তিরিশের দশকে চিকিৎসক সুধাংশু গুপ্ত নিজের বাড়ি ‘আনন্দ আশ্রম’-এ প্রসূতির চিকিৎসা করাতেন। তিনি ওখানে কালীপুজোও করতেন। পাড়ায় তাই ওই নার্সিংহোমের নাম ছিল ‘আঁতুড়ে কালী’। সেই পুজো আজও হয়।
স্বাভাবিক নিয়মে বদলেছে অনেক কিছু। কষ্ট হয় যখন দেখি জীবনযাত্রা বদলে যাওয়ায় পাড়ার আড্ডাটা ঠান্ডা ঘরে চলে গিয়েছে। রক রয়েছে, কিন্তু তা আলোচনায় সে ভাবে আর তেতে ওঠে না। তবে এ পাড়ার নিজস্ব দু’টি দুর্গাপুজো আজও উজ্জ্বল। আমার বাড়ির দুর্গাপুজো ১১১ বছরের। কালীপুজো ১৩৬ বছরের পুরনো। আর রয়েছে মনমোহন পাণ্ডে বাড়ির দুর্গাপুজো। উৎসাহ আগের তুলনায় কমলেও পুজো দেখতে, অঞ্জলি দিতে আসা মানুষের ভিড় এখনও রয়েছে। কালীপুজোয় এ বাড়ি থেকে ফানুস ওড়ানোর রীতিটাও বহু পুরনো। আজও পিতৃদত্ত এই শখের কোনও
বদল হয়নি।
সময়ের স্রোতে বয়ে গিয়েছে টিনের বাক্সবন্দি ঘুগনি-আলুর দম, কালো ট্রাঙ্কের কেক পেস্ট্রি। জলি চ্যাপ আর ম্যাগনোলিয়া আইসক্রিমের লড়াইটা তখন ছিল স্ট্যাটাস সিম্বল। প্যারাম্বুলেটরের মতো অদ্ভুত দর্শন গাড়িতে বৃহস্পতিবার করে আসতেন আলুর চপের ফেরিওয়ালা। সিমলে পাড়াতে এখনও তৈরি হয় উত্তরের গর্ব কুলফি মালাই। ঘোলা জলের লাইনের কলে পাইপ লাগিয়ে দিনে দু’বার রাস্তা ধোওয়া হত। পাইপ থেকে বেরনো হাওয়ার সঙ্গে জল মিলে যে ফটফট আওয়াজটা হত, সেটাও অনেক বছর আর শুনি না।
গরমের ছুটির দুপুরে বারান্দায় বসে বা জানালার খড়খড়ি ফাঁক করে গাড়ি গুনতাম। টানারিকশা অথবা গাড়ির দেখা পেতে বহু ক্ষণ অপেক্ষা করতে হত। এখন গাড়ির চাপে তো রাস্তা পেরনোই মুশকিল। ষাটের দশকেও লাহাবাড়ি থেকে নিয়মিত মেয়েরা দু’টি ঘোড়ায় টানা ফিটনে চেপে হোলি চাইল্ডে পড়তে আসতেন। ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হত পয়লা বৈশাখে। হেদুয়ায় দু’টি ঘুড়ির দোকান ছিল, কেষ্ট কাইট হাউজ আর নিতাই কাইট হাউজ। হাত্তা মারা নিয়ে বচসাও বাধত বন্ধুদের মধ্যে। এখন আকাশে ঘুড়ি কোথায়?
তবে এখন হেদুয়ার রক্ষণাবেক্ষণে যত্ন বেড়েছে। আগে ওখানে ওয়াটারপোলো খেলা হত নিয়মিত। নামকরা খেলোয়াড় ছিলেন ভুবনেশ্বর পাণ্ডে। এক বার হেদুয়া থেকে ওয়াটারপোলো টুর্নামেন্ট সম্প্রচারও করে দূরদর্শন। এখন তো এর প্রচার বা প্রশিক্ষণ কিছুই নেই। অনেকেই সাঁতার শেখেন আত্মরক্ষার জন্য। এ পাড়ারই বাসিন্দা ছিলেন গোবর গোহ। তাঁর ফাঁকা আখড়া দেখলে মনে হয় এ সময়ের বাঙালি বুঝি লড়াই থেকে মুখ ঘুরিয়েছে।
আগের মতো জল জমে না। আলো পর্যাপ্ত। বাড়ি থেকে নিয়মিত জঞ্জাল সংগ্রহও করা হয়। তবে পাড়ায় দু’টি খোলা ভ্যাট রয়েছে। একটি হেদুয়ার পিছনে। অন্যটি রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে। বাঙালি মিষ্টির প্রিয় হেঁশেল নকুড় ছাড়াও বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান রয়েছে হেদুয়া পাড়ার ও দিকে। তার সামনেই ভ্যাটটি বড্ড অস্বাস্থ্যকর। দু’টি ভ্যাটই তোলার কথা ভাবা উচিত পুরসভার। হেদুয়া পার্ক ও কলেজ সংলগ্ন জায়গায় সন্ধ্যার পরে পার্কিং করায় কিছু সমস্যা হয়। পুরসভা এ দিকটা নজর দিলে ভাল হয়।
আস্তে আস্তে এখানেও অবাঙালি প্রবেশ করছে। পুরনো বাড়িগুলো ভেঙে ফ্ল্যাট তৈরি শুরু হয়েছে। সেই ঢেউয়েই হারিয়ে গিয়েছে এ পাড়ার ল্যান্ডমার্ক সিনেমা জগতের বিখ্যাত পত্রিকা ‘উল্টোরথ’-এর বাড়ি। কী জানি! আরও কত পরিবর্তনের সাক্ষী হতে হবে।
লেখক পেশায় ব্যবসায়ী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy