Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

গুলির পিছনে সেই গোপাল দেখছে পুলিশ

বর্ণপরিচয়ের সুবোধ গোপাল নয়। বড়বাজারের কুখ্যাত দুষ্কৃতী গোপাল তিওয়ারি। বড়বাজারে চায়ের দোকানিকে গুলি করার ঘটনা তাকে গারদে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ভোটের কলকাতায় সাব-ইনস্পেক্টরকে গুলি করার ঘটনায় উঠে আসছে সেই গোপালেরই নাম। শনিবার মহানগরে ভোটের পর থেকেই পলাতক গোপাল।

সাব-ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডলকে গুলি করার অভিযোগে ধৃতদের তোলা হচ্ছে আদালতে। রবিবার সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

সাব-ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডলকে গুলি করার অভিযোগে ধৃতদের তোলা হচ্ছে আদালতে। রবিবার সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়, শিবাজী দে সরকার
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২৬
Share: Save:

বর্ণপরিচয়ের সুবোধ গোপাল নয়।

বড়বাজারের কুখ্যাত দুষ্কৃতী গোপাল তিওয়ারি।

বড়বাজারে চায়ের দোকানিকে গুলি করার ঘটনা তাকে গারদে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ভোটের কলকাতায় সাব-ইনস্পেক্টরকে গুলি করার ঘটনায় উঠে আসছে সেই গোপালেরই নাম। শনিবার মহানগরে ভোটের পর থেকেই পলাতক গোপাল।

শনিবার বিকেলে মধ্য কলকাতার সিংহিবাগান এলাকায় গিরিশ পার্ক থানার এসআই জগন্নাথ মণ্ডলকে গুলিটা কি তা হলে গোপালই করেছিল? গোয়েন্দারা বলছেন, না, গুলিটা গোপালের শাগরেদ ইফতিকার আলম করেছিল বলেই মনে করা হচ্ছে। ইফতিকারকে রবিবার গ্রেফতার করে তার কাছ থেকে একটি ৭.২ মিলিমিটার পিস্তল এবং দু’টি কার্তুজ উদ্ধার করা হয়েছে। রবিবার বাবুঘাটে হানা দিয়ে ওই দুষ্কৃতীর সঙ্গে আরও তিন জনকে ধরা হয়। পুলিশ জানায়, ধৃত অন্য তিন জন হল শিবকুমার রাউত, মনোজ মালি ও কিশোর পাসোয়ান। কিশোর ছাড়া বাকি সকলেই মেছুয়া এলাকার বাসিন্দা। শিবকুমার গোপালের ‘ডানহাত’। গোপালের দলের হয়েই তোলাবাজি-সহ নানান দুষ্কর্ম করে ইফতিকার, শিবকুমার ও মনোজ।

শুধু শাসক দল নয়, পুলিশের একাংশের সঙ্গেও দুষ্কৃতীদের দহরম-মহরমের নমুনা শনিবার রাতেই পেয়ে গিয়েছেন গোয়েন্দাকর্তারা। পুলিশি সূত্রের খবর, গোপাল যে তার দুষ্কর্মের খাসতালুক বড়বাজার এলাকার একটি বাড়িতে বসে ভোটে ‘অপারেশন’ চালাচ্ছে, সেই খবর আগেই ছিল। তাই পুলিশকে গুলি মারার পরে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করতে তেমন অসুবিধা হয়নি। তার ভিত্তিতেই রাতে শুরু হয় ধরপাকড়। লালবাজারের অন্দরের খবর, গুন্ডা দমন শাখার এক অফিসার ধরপাকড়ের উদ্যোগ পর্বেই কর্তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, গোপাল এতে জড়িত নয়। তবে তাঁর কথায় কান দেননি লালবাজারের অধিকাংশ কর্তা। কিন্তু তাঁরা গোপালকে জালে ফেলতেও পারেননি। গুলির ঘটনার পর থেকেই সে বেপাত্তা। ‘‘যতই পালিয়ে বেড়াক, গোপালকে গ্রেফতার করা হবেই। তার বন্ধুরাও বাঁচাতে পারবে না,’’ বলছেন এক গোয়েন্দাকর্তা।

এর আগে বড়বাজারে একটি নামী মিষ্টির দোকানের সামনে চায়ের দোকানিকে গুলি করার অভিযোগে গোপালকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে সে জামিন পায়। তার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অজস্র অভিযোগ আছে বলে জানাচ্ছে লালবাজার।

মধ্য কলকাতায় ভোটের ‘কাজ’ করে বেড়ানো এমন লোকেদের সঙ্গে পুলিশের একাংশের যোগসাজশও এখন লালবাজারের কাছে পরিষ্কার! এসআই-কে গুলির ঘটনায় দুষ্কৃতীদের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এমন সব লোকের কথা বলছে, যাঁদের মধ্যে ১৭ বছরের তৃণমূলকর্মীও আছেন। শনিবার রাতে গ্রেফতার করা হয় অশোক শাহ ওরফে মন্টু এবং দীপক সিংহ ওরফে পাপাই নামে দুই তৃণমূলকর্মীকে।

পুলিশ অফিসারকে গুলির ঘটনার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে প্রাক্তন বিধায়ক এবং তৃণমূল নেতা সঞ্জয় বক্সীর নাম। পুলিশের খবর, ঘটনাস্থলে সঞ্জয়বাবু নিজে ছিলেন না। কিন্তু মন্টু ও পাপাইকে তাঁর দলীয় অফিস থেকে পাকড়াও করা হয়েছে। মন্টু এলাকায় সঞ্জয়বাবুর ‘আস্থাভাজন’ বলেই পরিচিত। একই ইঙ্গিত দিয়েছেন মন্টুর কাকা রাজকুমার শাহ। তৃণমূলকর্মী রাজকুমারের কথায়, ‘‘আমরা ১৯৯৮ সাল থেকেই সঞ্জয় বক্সীর নেতৃত্বে তৃণমূল করি। সন্ধ্যায় সঞ্জয়দার অফিসে বসে ছিলাম। সেই সময় ডিসি (সে‌ন্ট্রাল) বাহিনী নিয়ে এসে মন্টুদের তুলে নিয়ে যান।’’

অভিযুক্তেরা যে তাঁর ঘনিষ্ঠ, সঞ্জয়বাবু তা অস্বীকার করেননি। তিনি বলেন, ‘‘শুধু মধ্য কলকাতা কেন, পশ্চিমবঙ্গে অনেকেই আমার পরিচিত। আমার অফিস থেকেই ওদের নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ।’’ এই ঘটনায় তৃণমূলকর্মীরা যুক্ত নন, এমন কথা জোর গলায় বলতে পারেননি ওই প্রাক্তন বিধায়ক। তবে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘এই ঘটনায় কংগ্রেসের কাউকে গ্রেফতার করা হল না কেন?’’

গোয়েন্দাদের দাবি, জেরার মুখে ধৃত দুষ্কৃতীরা জানিয়েছে, ভোটের কাজের জন্য তাদের ভাড়া করা হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছে, সঞ্জয়বাবুর হয়েই ভোটে কাজ করার জন্য গোপাল তাদের নিয়ে এসেছিল। সঞ্জয়বাবু অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘গোপালের কথা সন্তোষ পাঠক (কংগ্রেস নেতা) বলতে পারবেন। ওর সঙ্গে তো আরও অনেক দুষ্কৃতীও ছিল।’’ সন্তোষবাবু পাল্টা অভিযোগে বিঁধেছেন তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক সঞ্জয়বাবুকেই।

পুলিশ জানাচ্ছে, ভোটের দিন সকাল থেকেই মোটরবাইক নিয়ে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে সিংহিবাগান-সহ ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের নানা এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল মন্টু, পাপাই, ইফতিকারেরা। সেই দলে কিছু হাওড়ার দাগি দুষ্কৃতীও ছিল। কিন্তু সব দেখেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। বরং কংগ্রেস বেলা সাড়ে ৩টে নাগাদ গিরিশ পার্কে পথ অবরোধ করলে পুলিশের সঙ্গে ওই তৃণমূলকর্মীরা গিয়ে তা তুলে দেয় বলে অভিযোগ। অবরোধের সময় গিরিশ পার্কে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন রাজকুমার। তিনি বলেন, ‘‘ওরা আমাদের দল ও নেতার নামে গালি দিয়েছিল বলেই কর্মীরা গিয়েছিল।’’

এসআই-কে গুলি করা হল কেন?

এলাকার কংগ্রেস নেতা বিকাশ যাদবের বক্তব্য, বেলা সাড়ে ৩টে নাগাদ অবরোধ তুলে দেওয়ার পরে রাজেন্দ্র মল্লিক স্ট্রিটে কংগ্রেসের কার্যালয়ে বোমা পড়তে থাকে। তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই দু’দিক থেকে হামলা চালায় তৃণমূলকর্মীরা। পরপর তিনটি বোমা ফাটে। তার পরেই গুলির আওয়াজ শুনতে পান বিকাশ। তাঁর কথায়, ‘‘ওই সময় কেউ আমার জামা ধরে টেনেছিল। তা না-হলে গুলি হয়তো আমার গায়েই লাগত।’’

ধৃতদের জেরা করেও অনেকটা একই বয়ান পেয়েছেন তদন্তকারীরা। তাঁরা জানান, সিংহিবাগানের ওই এলাকায় এক দিক থেকে ইফতিকার দলবল নিয়ে হামলা করে। অন্য দিক থেকে আসা দলের সামনে ছিল মন্টু ও পাপাই। বোমাবাজির পরেই গুলি চালায় ইফতিকার। লালবাজারের দাবি, পুলিশকর্মীদের তাক করেই গুলি চালানো হয়েছিল। ভোটে দুষ্কৃতীদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমও। একই সঙ্গে দুষ্কৃতী দমনের কাজটা যে পুলিশের, তা মনে করিয়ে দিয়ে এই কাজি পুলিশি ব্যর্থতার জন্য তাদের কটাক্ষও করেছেন তিনি। পুরমন্ত্রী বলেন, ‘‘দুষ্কৃতী আছে বলেই তো পুলিশ আছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে দুষ্কৃতীরা চলে গেলে পুলিশ রাখার দরকার ছিল না। সকলকে ওয়ার্ড বয় করে দিয়ে হাসপাতালে কাজ বাড়িয়ে দিতাম!’’ মন্ত্রীর তির্যক মন্তব্য যাদের উদ্দেশে, সেই পুলিশ বলছে, শাসক দলের দুষ্কৃতীরা ভোটে নেমেছিল।

মন্টু ও পাপাইকে এ দিন ব্যাঙ্কশাল আদালতে তোলা হয়। তাদের হয়ে গলা ফাটাতে হাজির ছিলেন মন্টুর কাকা রাজকুমার-সহ এলাকার তৃণমূলকর্মীরা। আদালতে তোলার সময় পুলিশ অভিযুক্তেরা হইচই শুরু করেন। পরে ভবানী ব্যানার্জি লেনের বাড়িতে বসে রাজকুমার বলেন, ‘‘পুলিশ নিজেদের পিঠ বাঁচাতে মন্টু-পাপাইকে ফাঁসিয়েছে। ওরা নির্দোষ।’’ তবে ইফতিকার-সহ বাকি ধৃতদের চেনেন না বলে দাবি করেছেন তিনি।

শাসক দল যে মন্টুদের ঝেড়ে ফেলছে না, তার প্রমাণ আদালতেও মিলেছে। ওই দুই অভিযুক্তের হয়ে সওয়াল করেন পুরভোটে তৃণমূল প্রার্থী অনিন্দ্য রাউত এবং আর এক আইনজীবী সন্দীপ ঘোষ। অনিন্দ্যবাবু আদালতে বলেন, ‘‘পুলিশ মিথ্যা অভিযোগে ওই দু’জনকে ফাঁসিয়েছে।’’ ধৃতদের জামিনের আর্জিও জানান তিনি। তা খারিজ করে বিচারক এডেন লামা ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত ধৃতদের পুলিশি হাজতে রাখার নির্দেশ দেন। আজ, সোমবার ব্যাঙ্কশাল আদালতে তোলা হবে বাকি চার অভিযুক্তকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE