Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সরকারি হাসপাতাল

ছ’মাসেও তৈরি হল না ‘ফ্রি’ অস্ত্রোপচার ব্যবস্থা

সিলেবাস জানা ছিল। পরীক্ষা শুরুর সময়ও। কিন্তু আগে প্রস্তুতি না নিয়ে পরীক্ষা শুরুর পরে পড়তে গিয়েই এখন নাকানিচোবানি অবস্থা সরকারি হাসপাতালগুলির। দুপুর ১টা কি বড়জোর দুটো। তার মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছে অস্ত্রোপচার। চলে যাচ্ছেন ডাক্তার।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৫ ০০:১৯
Share: Save:

সিলেবাস জানা ছিল। পরীক্ষা শুরুর সময়ও। কিন্তু আগে প্রস্তুতি না নিয়ে পরীক্ষা শুরুর পরে পড়তে গিয়েই এখন নাকানিচোবানি অবস্থা সরকারি হাসপাতালগুলির।

দুপুর ১টা কি বড়জোর দুটো। তার মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছে অস্ত্রোপচার। চলে যাচ্ছেন ডাক্তার। অ্যানাস্থেটিস্টদের ঘর ফাঁকা। ও টি নার্সরাও চাপমুক্ত। যেন ছুটির হাওয়া হাসপাতাল জুড়ে। শুধু করুণ মুখে প্রতিদিন অস্ত্রোপচারের ‘ডেট’ চেয়ে ফিরে যাচ্ছেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ। পিছোতে পিছোতে ক্রমশ অনিশ্চয়তার দিকে পৌঁছে যাচ্ছে বহু পরিকল্পিত অস্ত্রোপচার।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারি হাসপাতালে সব পরিষেবা সবার জন্য ফ্রি ঘোষণার পর থেকেই কার্যত এই অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে অর্থোপেডিক, কার্ডিওলজি-সহ আরও কিছু অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে, যেখানে বাইরে থেকে কোনও সরঞ্জাম শরীরে বসাতে (ইমপ্ল্যান্ট) হয়। হাসপাতালে সেই সব সরঞ্জামের বেশির ভাগই মজুত নেই। ‘ফ্রি’-র তত্ত্ব মানতে গেলে তা রোগীর বাড়ির লোককে কিনে আনতেও বলা যাবে না। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যেটা করা হচ্ছে, তা হল রোগী প্রত্যাখান। ফলে এক ধাক্কায় রোগী প্রত্যাখানের হার কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে সরকারি হাসপাতালগুলিতে।

প্রশ্ন উঠেছে, কেন আচমকা এ ভাবে সিদ্ধান্ত কার্যকরী করতে বলা হল? স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে-র পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘কে বলেছে আচমকা? ছ’মাস আগে সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে জানানো হয়েছিল। তাঁদের বলা হয়েছিল, ‘প্রস্তুত হতে শুরু করুন।’ কেউ বিন্দুমাত্র কান দেননি সেই কথায়। এখন যখন জলে ঠেলে দেওয়া হল, তাঁরা বলছেন সাঁতার জানি না। অথচ সাঁতার শেখার সুযোগ তাঁদের দেওয়া হয়েছিল।’’

স্বাস্থ্যসচিবের দাবি, এই সমস্যা বড়জোর আর মাসখানেক। তার মধ্যেই তাঁরা সব কিছু স্বাভাবিক করে নেবেন। তাঁর বক্তব্য, ওষুধ সংক্রান্ত সমস্যা ধাপে ধাপে নিয়ন্ত্রণে আসছে। তবে সার্জিক্যাল ইমপ্ল্যান্ট নিয়ে সমস্যা এখনও মেটানো যায়নি। মলয়বাবুর কথায়, ‘‘ডাক্তারদের সব অজুহাত মেটানোর চেষ্টা করছি। আমরা চাই রোগী ফেরানোর মতো কোনও অজুহাত যেন ডাক্তার বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে না থাকে। সম্ভাব্য যত ওষুধ বা সরঞ্জাম প্রয়োজন হতে পারে, সবটাই তালিকায় ঢোকাতে বলা হচ্ছে। এটা আমাদেরও জেদ।’’

বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ঘুরে যে তথ্য পাওয়া গিয়েছে, তা থেকে স্পষ্ট যে গোল বেধেছে মূল়ত সার্জিক্যাল আইটেম নিয়েই। আগে ছোট-বড় যে কোনও ক্ষেত্রে পত্রপাঠ রোগীর বাড়ির লোককে স্লিপ ধরিয়ে সরঞ্জাম কিনে আনতে বলা হত। পেয়িং বেড তো বটেই, এমনকী ফ্রি বেডের রোগীকেও ৩৫-৪০ হাজার টাকা বা তারও বেশি দামের সরঞ্জামের প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেওয়া হত। এখন সেটা করা যাচ্ছে না। ফলে সবচেয়ে সহজ রাস্তাই বেছে নিচ্ছেন ডাক্তারেরা। বাতিল হচ্ছে পরের পর অস্ত্রোপচার।

বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা। এসএসকেএমের জেনারেল লেকচার থিয়েটারে তখন ফ্রি পরিষেবা নিয়ে জরুরি বৈঠক ডেকেছেন কর্তৃপক্ষ। কোথায়, কোথায় সমস্যা, কেন রোগী ফেরত পাঠানো হচ্ছে— ডাক্তারদের কাছ থেকে খতিয়ান নেওয়া হচ্ছে। তখনই অর্থোপেডিক বিভাগের সামনে মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে এক প্রৌঢ়। ছেলের ফিমার বোন ভেঙে গিয়েছে। ধাতব পাত বসাতে হবে। সাত দিন ধরে ঘুরে যাচ্ছেন তিনি। অস্ত্রোপচার কবে হবে, ডাক্তাররা কেউই বলতে পারছেন না। বললেন, ‘‘ডাক্তারবাবুরা বলেছেন, অপেক্ষা করতে হবে। যদি খুব তাড়া থাকে, তা হলে বাইরের নার্সিংহোমে যেতে হবে।’’

ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের সার্জারি বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘আমাদের এখানেও একই অবস্থা। আগে অস্ত্রোপচার শেষ হতে হতে কখনও কখনও সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যেত। এখন সেই ছবি বদলে গিয়েছে। দুপুর দুটোর মধ্যে সব শেষ।’’

মেডিক্যাল কলেজ, আর জি করেও একই অবস্থা। আর জি করের এক কর্তা বলেন, ‘‘আমরা হাবুডুবু খাচ্ছি। এক দিকে ডাক্তাররা অসহযোগিতা করছেন, অন্য দিকে রোগীর পরিজনেরা প্রতি দিন অভিযোগ করছেন। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা কী ভাবে করব জানি না।’’

স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, হাসপাতালের স্টোরে যে সব ওষুধ অবশ্যই থাকার কথা, বছরের পর বছর তা আনা হয়নি। তা নিয়ে স্টোরকিপার থেকে শুরু করে সুপার, কোনও স্তরেই হেলদোল ছিল না। নজরদারি ছিল না স্বাস্থ্য ভবনেরও। এখন তাই ত্রাহি-ত্রাহি রব সর্বত্র।

বুধবার এসএসকেএমে সার্জারি বিভাগে অজ্ঞান করার ইঞ্জেকশন পাওয়া যায়নি বলে কিছু অস্ত্রোপচার বাতিল হয়। একই অবস্থা হয় ইএনটি বিভাগেও। হাসপাতাল সূত্রে খবর, পরিস্থিতি সামলাতে ওই বিভাগ থেকে ২০০টি ইঞ্জেকশন চাওয়া হলে স্টোর থেকে পাঠানো হয় ১০টি। কারণ বিভিন্ন বিভাগেই তো ওই ইঞ্জেকশনের চাহিদা। স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, ফ্রি পরিষেবা চালু হওয়া বা না হওয়ার প্রশ্ন নয়। অজ্ঞান করার ইঞ্জেকশন তো একেবারে গোড়ার প্রয়োজন। যখন তাও পর্যাপ্ত মজুত থাকে না, তখন বুঝতে হবে গলদটা গোড়াতেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE