Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

জালিয়াত ‘মশারি-বাহিনী’, ঝাড়খণ্ড থেকে ধৃত চাঁই

রাত হলেই দল বেঁধে এক দল যুবক-কিশোর মশারি হাতে টিলার উপরে ঘুমোতে যান। সকাল হলে ফিরে আসেন বাড়িতে। ঝাড়খণ্ডের কর্মটাঁড়ে এই দৃশ্য দেখে কিছুটা অবাক হয়েছিলেন কলকাতা পুলিশের তিন অফিসার। বিষয়টি লালবাজারে জানাতেই নির্দেশ যায়, ওই এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে দলটির উপরে নিয়মিত নজরদারি চালাতে।

অঙ্কন: সুমিত্র বসাক

অঙ্কন: সুমিত্র বসাক

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

রাত হলেই দল বেঁধে এক দল যুবক-কিশোর মশারি হাতে টিলার উপরে ঘুমোতে যান। সকাল হলে ফিরে আসেন বাড়িতে। ঝাড়খণ্ডের কর্মটাঁড়ে এই দৃশ্য দেখে কিছুটা অবাক হয়েছিলেন কলকাতা পুলিশের তিন অফিসার। বিষয়টি লালবাজারে জানাতেই নির্দেশ যায়, ওই এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে দলটির উপরে নিয়মিত নজরদারি চালাতে।

গোয়েন্দারা দেখেন, মশারির ভিতরে ঢুকে রাতভর মোবাইলে ফোনের পর ফোন করে চলেছে ওই কিশোর-যুবকেরা। দু’চোখের পাতা এক না করে টিলার উপরে মশারি টাঙিয়ে দল বেঁধে কাকে ফোন করছেন তারা? এর উত্তর খুঁজতে গিয়েই গোয়েন্দারা ধরে ফেললেন ব্যাঙ্ক জালিয়াতির এক বড় চক্রকে।

পুলিশ জানিয়েছে, ওই কিশোর ও যুবকেরা ব্যাঙ্ক জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত। এলাকায় মোবাইলের সংযোগ তেমন ভাল না হওয়ায় রাতে ‘জালিয়াতি’র ফোন করতে টিলায় চড়তেন তাঁরা। মশার হাত থেকে বাঁচতে সঙ্গে নিতেন মশারি। টানা পাঁচ দিন এই মশারি-বাহিনীর উপর নজরদারি করেই তাদের চাঁইকে পাকড়াও করে লালবাজারের ব্যাঙ্ক জালিয়াতি দমন শাখা। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ জানান, ধৃতের নাম অরুণকুমার মণ্ডল। তার কাছে থেকে তিনটি স্মার্টফোন এবং ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নথি উদ্ধার হয়েছে। ১ জুলাই দেবাশিস ঠাকুর নামে এক ব্যক্তি তাঁর ২২ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ করেন। আপাতত ওই মামলায় অরুণকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে সে এমন আরও ঘটনায় জড়িত বলে পুলিশের দাবি।

গোয়েন্দা দফতর সূত্রের খবর, ওই ঘটনার একটি সূত্রে কর্মটাঁড়ে যান লালবাজারের ব্যাঙ্ক জালিয়াতি দমন শাখার তিন অফিসার বিশ্বজিৎ নস্কর, অমিত সিংহ ও জিতেন্দ্র প্রসাদ। তখনই পাহাড়ে যাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে তাঁদের। এর পরেই টানা সাত দিন ধরে ওই গ্রামে পর্যটকের ছদ্মবেশে ঘাঁটি গেড়েছিলেন তাঁরা। টানা নজরদারি চালিয়ে মঙ্গলবার রাতে অরুণকে পাকড়াও করা হয়।

পুলিশ জানিয়েছে, কর্মটাঁড়ের মনজলডিহি গ্রামে জালিয়াতির ব্যবসা ফেঁদেছিল বি.এ পাশ অরুণ। গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত যুবক ও কিশোরদের সে এই কাজে নিয়োগ করেছিল। ব্যাঙ্কের কাস্টমার কেয়ার এগজিকিউটিভ হিসেবে কথা বলার প্রশিক্ষণও দিয়েছিল। পুলিশের দাবি, এই জালিয়াতির আয়ের সুবাদেই গ্রামের বেশির ভাগ যুবকের কাছে মোবাইল, মোটরবাইক পৌঁছে গিয়েছে। পল্লববাবু বলেন, “গত ১৫ দিনে অরুণের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা জমা পড়েছে। সে প্রমাণ পেয়েছি।” কিন্তু অরুণের সঙ্গীদের পাকড়াও করা হল না কেন?

পুলিশের বক্তব্য, অরুণই জালিয়াতির মূল চাঁই। তাকে ধরার পরে বাকিদের গ্রেফতারের তেমন প্রয়োজন নেই। এক পুলিশকর্তা বললেন, “অত লোককে পাকড়াও করে আনতে ট্রেনের একটা গোটা কামরা ভাড়া করতে হত।”

সম্প্রতি শহর জুড়ে মোবাইলের মাধ্যমে একের পর এক ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ঘটনা ঘটছিল। নিত্য দিন এমন অভিযোগে কার্যত নাজেহাল হচ্ছিলেন লালবাজারের গোয়েন্দারা। অরুণ ধরা পড়ার পরে সেই জালিয়াতির ঘটনায় লাগাম পড়বে বলেই পুলিশের আশা। কী ভাবে ঘটছিল এই জালিয়াতি?

গোয়েন্দা দফতর সূত্রের খবর, রাত হলেই একটি মেসেজ আসত শহরের বিভিন্ন ব্যাঙ্ক গ্রাহকের কাছে। বলা হত, “আপনার ডেবিট কার্ড সাময়িক ভাবে বন্ধ (ব্লক) হয়ে গিয়েছে।” এর পরেই ফোন আসত ওই গ্রাহকের কাছে। নিজেকে কাস্টমার কেয়ার এগজিকিউটিভ পরিচয় দিয়ে জালিয়াতেরা অ্যাকাউন্ট নম্বর, ডেবিট কার্ড নম্বর ও পাসওয়ার্ড (পিন) জেনে নিত। পুলিশ জানিয়েছে, কার্ড পুনরায় চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওই সব তথ্য চাইত জালিয়াতেরা। অনেকেই সেগুলি দিয়ে দিতেন। তার পরেই গ্রাহকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উধাও হয়ে যেত।

পুলিশ জানাচ্ছে, ইদানীং মোবাইল সংস্থাগুলি ফোনের মাধ্যমে টাকা লেনদেনের ব্যবস্থা চালু করেছে। জালিয়াতেরা সেগুলিই ব্যবহার করত। প্রথমে মোবাইল ব্যবহার করে গ্রাহকদের টাকা নিজের মোবাইল ফোনের অ্যাকাউন্টে নিয়ে নিত। সেখান থেকে একের পর এক মোবাইল বদলে টাকা একটি অ্যাকাউন্টে জমা পড়ত। সেখান থেকে টাকা তুলে নিত জালিয়াতেরা। এ ধরনের লেনদেনে এক বারে বড় অঙ্কের টাকা লেনদেন করা যায় না। তাই ছোট বা মাঝারি অঙ্কের টাকাই হাতানো হত।

প্রশ্ন উঠেছে, মোবাইল-পরিষেবায় টাকা লেনদেনের এই ব্যবস্থা নিয়েও। অনেকেই বলছেন, ওই ব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি রয়েছে। কারণ, ওই পরিষেবায় অ্যাকাউন্ট খুলতে একটি ফোন নম্বর ও পরিচয়পত্রের ফটোকপিই যথেষ্ট। ভুয়ো নথি দিয়ে সিম কার্ড কিনে এই পরিষেবা ব্যবহার করত জালিয়াতেরা। এই ঘটনা স্বীকার করেছে লালবাজারও। পুলিশ সূত্রের জানা গিয়েছে, ব্যাঙ্ক জালিয়াতি শাখার ওসি সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ নিয়ে মোবাইল পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলির সঙ্গে কথা বলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

imposter leader arrestred kolkata police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE