সাবেক পুজো ছেড়ে থিমের পুজোয় নাম লেখাবেন। উত্তর কলকাতার এক পুরনো পুজোর কর্তারা তাই ধরলেন এক জন নামী শিল্পীকে। কিন্তু সে বছর ঠিক ব্যাটে-বলে হল না। পরের বছর ফের এক নামী শিল্পী। তবুও ঠিক ততটা সাফল্য এল না। অষ্টমীর রাতে পুজো-সম্পাদকের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, দশমী এসে গিয়েছে! আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘‘অনেক খরচ করলাম। তবু থিমটা ঠিক খুলল না।’’
থিম পুজোর রমরমায় প্রতি বারই এমন অবস্থা হয় বেশ কিছু পুজো কমিটির। ধারে ও ভারে এগিয়ে থাকলেও থিম ঠিক খোলে না। কোথাও আবার পুরনো বছরের থিমকেই নতুন মোড়কে চালিয়ে দেন। তাতে জাঁক থাকলেও মন ভরে না দর্শকের। আবার উল্টোটাও হয়। প্রতি বছরই থিমের বাজারে নতুন চমক দেয় কিছু পুজো। অভিনব ভাবনা কিংবা উপকরণ ব্যবহারের তাক লাগে লোকজনের। এ বারও উৎসব কাপে এমনই চমক দেওয়ার জন্য তাল ঠুকছে বেশ কিছু পুজো কমিটি। তাদের কেউ তুলে এনেছেন গুরুতর সামাজিক সমস্যাকে, কেউ বা
লুপ্তপ্রায় লোকশিল্পকে নতুন চেহারায় হাজির করছেন। কোনও পুজোয় আবার শিল্পী তাক লাগাচ্ছেন উপকরণের ব্যবহারেও।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় কন্যাভ্রূণ হত্যা এক সামাজিক ব্যাধির আকার নিয়েছে। এ রাজ্যে ভ্রূণহত্যা না হলেও বহু পরিবারেই মেয়ে সন্তানকে ‘বোঝা’ হিসেবেই দেখা হয়। এ সবের বিরুদ্ধেই এ বার থিম গড়েছে উত্তরের কাশী বোস লেন পুজো কমিটি। তরুণ শিল্পী প্রদীপ দাসের হাত ধরে মণ্ডপ সাজছে খুদে মেয়ের মূর্তি দিয়ে। মূল মণ্ডপের সামনে থাকছে ফুলের উপর ঘুমোনো এক শিশুমূর্তি। কন্যাসন্তান থিম হওয়ায় এই পুজোর সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে রাজ্যের নারী ও সমাজকল্যাণ দফতর। কন্যাভ্রূণ নিয়ে থিম গড়েছে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের চেতলা অগ্রণীও। শিল্পী সনাতন দিন্দা সেখানে মণ্ডপ সাজাচ্ছেন ফেলে দেওয়া তেলের ড্রাম, টিনের কৌটো দিয়ে।
অর্জুনপুরের আমরা সবাই ক্লাবেও এ বার শিল্পী পিয়ালি সাধুখাঁ এবং তাঁর দুই সঙ্গী সৌমিক চক্রবর্তী ও প্রদীপ পাত্র কন্যা সন্তানকেই থিম হিসেবে
বেছে নিয়েছেন।
শিল্পী কমলদীপ ধরের হাত ধরে সাঁওতালদের পুতুলনাচ ‘চদর-বদর’ দেখেছিল কলকাতা। উত্তরের ভিড়ের একটা বড় অংশ ছুটেছিল নবীনপল্লিতে। এ বার সেখানে তরুণ শিল্পী মহেন্দ্র পাল তুলে এনেছেন কাগজশিল্প ‘পেপার ম্যাশে’-কে। পুজোকর্তা অমিতাভ রায় বলছেন, ১০৫ শতকে চিনে এই শিল্পের কথা জানা গিয়েছিল। পরে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ঘুরে এই শিল্প পৌঁছেছিল ইওরোপ ও মার্কিন মুলুকেও। কিন্তু সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসে বসেছে এই শিল্প। তাই পুজোতে এমনই বিষয় বেছে নিয়েছেন শিল্পী। প্রতিবেশীকে টেক্কা দিতে এ বার শিকদারবাগানও তুলে এনেছে অন্ধ্রপ্রদেশের লোকশিল্প তোলু বোম্মলতাকে। রাখাল ছেলের হাতে তৈরি চামড়ার পুতুলের বদলে শিল্পী মানস রায় সেখানে তৈরি করছেন কাগজের পুতুল।
কাগজের চমক দিচ্ছে নলিন সরকার স্ট্রিটও। সেখানে শিল্পী পরিমল পাল কাগজের পাশাপাশি মাটি ও ব্যাকলিট শিটকেও তুলে এনেছেন মণ্ডপসজ্জায়। পুজোকর্তা সিদ্ধার্থ সান্যাল বলছেন, ‘‘সব মিলিয়ে আমাদের পুজোর পরিবেশটাই হয়ে উঠবে নতুন এক চমক।’’
কুটিরশিল্পের লড়াইয়ে বাংলার তাঁতকে হাজির করেছে ঠাকুরপুকুর ক্লাব। শিল্পী দেবাশিস ভট্টাচার্য মণ্ডপসজ্জার পাশাপাশি আলোকসজ্জাতেও তাঁতের শাড়ি ব্যবহার করছেন।
কলকাতার পুরনো লোকেরা বলছেন, এক সময় বড় প্রতিমায় নজর কাড়ত সঙ্ঘশ্রী। কুমোরটুলি থেকে প্রতিমা বেরনোর সময় রীতিমতো ভিড় জমে যেত। সাবেক কায়দা ছেড়ে বেশ কয়েক বছর আগেই থিমের হাত ধরেছে সঙ্ঘশ্রী। এ বার তারা তুলে ধরছে বাংলার পুরনো রঙ্গমঞ্চকে।
আবার সঙ্ঘশ্রীর সেই সেই বিরাট আকারের চমকটাকেই এ বার হাতিয়ার করেছে দেশপ্রিয় পার্ক পুজো কমিটি। বৈশাখের শুরু থেকেই সিমেন্ট সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ‘এত বড় সত্যি’র বিজ্ঞাপনে যারা শহর ভরিয়েছিল। অনেকেই বলছেন, দেশপ্রিয় পার্কের প্রতিমার যা বর্ণনা শোনা যাচ্ছে, তাতে ফিরে আসছে এক সময়ের সঙ্ঘশ্রীর মতো পুজোগুলির স্মৃতি। যদিও দেশপ্রিয় পার্কের পুজোকর্তারা বলছেন, কলকাতা তো ছাড়, পৃথিবীর কোথাও এত বড় দুর্গামূর্তি আগে হয়নি।
যেমন বিরাট আকারের সেফটিপিন তুলে ধরছে সন্তোষপুর অ্যাভিনিউ সাউথ। মণ্ডপ সাজাতে প্রায় ২ কোটি ৪০ লক্ষ সেফটিপিনের পাশাপাশি শিল্পী রিন্টু দাস সেখানে হাজির করছেন ২২ ফুটের সাতটি সেফটিপিন। তাতে ফুটে উঠবে দুর্গার সাতটি রূপ।
চমকের মানে যদি মায়াবি পরিবেশ হয়, তা হলে যেতে হবে হরিদেবপুর ৪১ পল্লীতে। শিল্পী গৌরাঙ্গ কুইল্যার হাত ধরে সেখানে দেখা মিলবে ভাসমান ছবির! সেটা ঠিক কেমন হবে, তা অবশ্য এখনই খোলসা করতে নারাজ ওই পুজোর কর্তারা।
আসলে তুরুপের তাসটা আপাতত আস্তিনেই রাখতে চাইছেন সবাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy