Advertisement
১৯ মার্চ ২০২৪

নম্বর বাড়াতেই দাদাগিরি চারমূর্তির

বাংলা সংস্কৃতির দ্বার রক্ষায় চার নতুন মূর্তি। এক জন বললেন, “মিডিয়ার একটা মালও যেন ভিতরে ঢুকতে না পারে।” দ্বিতীয় জন, “আমরা মৌনমিছিল করব। সবাই চুপচাপ হাঁটবেন।” তৃতীয় জন মুখে কথা না বলে ধাক্কা দিয়ে লোক সরাতে ব্যস্ত থাকলেন। চতুর্থ জন থাকলেন ভিড়ে মিশে। মিছিল করার চেয়ে নিজেদের প্রমাণ করার দায় ছিল বেশি। তাই ওঁদের আস্ফালন দেখে পিছু হটলেন অন্যরা।

মিছিলের মুখ। দেব ও অরিন্দম শীল। শুক্রবার অ্যাকাডেমি চত্বরে সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।

মিছিলের মুখ। দেব ও অরিন্দম শীল। শুক্রবার অ্যাকাডেমি চত্বরে সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৪৮
Share: Save:

বাংলা সংস্কৃতির দ্বার রক্ষায় চার নতুন মূর্তি।

এক জন বললেন, “মিডিয়ার একটা মালও যেন ভিতরে ঢুকতে না পারে।” দ্বিতীয় জন, “আমরা মৌনমিছিল করব। সবাই চুপচাপ হাঁটবেন।” তৃতীয় জন মুখে কথা না বলে ধাক্কা দিয়ে লোক সরাতে ব্যস্ত থাকলেন। চতুর্থ জন থাকলেন ভিড়ে মিশে।

মিছিল করার চেয়ে নিজেদের প্রমাণ করার দায় ছিল বেশি। তাই ওঁদের আস্ফালন দেখে পিছু হটলেন অন্যরা। শ্রীকান্ত মোহতা, অরিন্দম শীল, ইন্দ্রনীল সেন এবং সুবোধ সরকার। যদিও চার জনের কেউই তখনও জানতেন না, এ দিন দুর্গাপুরের সভা থেকে কিন্তু মিছিল নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি মুখ্যমন্ত্রী।

অথচ সোমবার মহানগরে দলীয় মিছিলের পরে সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে মিছিল সফল করার দায়িত্ব এই চার জনকে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। নেই নির্দেশমাফিক অরিন্দম গত দু’দিন ধরে এসএমএস পাঠিয়ে সেলিব্রিটিদের মিছিলে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন। মিছিলের উদ্দেশ্য-বিধেয় মিডিয়ার কাছে ব্যাখ্যা করার কাজটা করছিলেন সুবোধ। শ্রীকান্ত টলিউড-অধিপতির ভূমিকায় নেমে ইন্ডাস্ট্রিকে জড়ো করছিলেন। তিন জনই তৃণমূল শিবিরে নবাগত। গায়ক ইন্দ্রনীল অবশ্য দল পাল্টানোর কাজটা এঁদের অনেক দিন আগেই সেরে ফেলেছিলেন। ভোটেও লড়েছেন। সুতরাং মিটিং-মিছিলের ব্যাপারে তিনি বেশ কিছু দিন ধরেই সড়গড়।

দুপুর একটার কিছু আগে থেকেই এ দিন নন্দনে জড়ো হতে শুরু করেছিল টলিউডের পরিচিত কিছু মুখ। শুরুতেই তাঁদের সতর্ক করে দিয়ে অরিন্দম বললেন, “সব্বাইকে বলে দিচ্ছি, কেউ প্রেসের সঙ্গে কথা বলবে না। যা বলার আমি বলব।” পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন মিমি, সোহম, নুসরতরা। তাঁদের দিকে তাকিয়ে প্রায় হুমকি দিলেন তিনি, “অ্যাই, ওরা যত খুশি ডাকুক। আমরা তাকাবও না ওদের দিকে। মিমি, মনে থাকে যেন।” সানগ্লাসটা মাথার উপরে তুলে মিমি বরাভয় দেওয়ার ভঙ্গি করলেন।

‘আমরা’ মানে টলিউডের শিল্পীকুল, ‘ওরা’ হল মিডিয়া। অরিন্দমরাই ঠিক করে দিয়েছেন, দড়ি দিয়ে ঘেরা ব্যারিকেডের মধ্যে কারা ঢুকবেন, কাদের ধাক্কা মেরে বার করে দেওয়া হবে।

মিছিল শুরু হব-হব। সাহেব ভট্টাচার্য আর রাজ চক্রবর্তী ঢুকলেন। দু’জনকেই গলায় স্লোগান লেখা বোর্ড ঝোলাতে বলা হল। নিমরাজি সাহেব বলেন, “এটা কি না পরলেই নয়? গরম লাগছে তো!” অরিন্দম মুখে হাসি নিয়ে কড়া গলায় বললেন, “গলায় জড়িয়ে নাও ভাই। সিজন্ড হও।” তার পরেই বিরক্ত মুখে পিয়া দাসকে বলে উঠলেন, “সোনালিরা কোথায়? দেব কখন ঢুকবে? ফোন করো এক বার।”

অরিন্দম থামতেই শুরু করলেন ইন্দ্রনীল “সবাই রেডি তো? এ বার শুরু করতে হবে। আমরা মৌনমিছিল করব।” ইন্দ্রনীলের কথা শেষ হওয়ার আগেই উদ্যোক্তাদের এক জন হ্যান্ড মাইক নিয়ে চেঁচাতে শুরু করলেন, “লাইন সোজা রাখুন। পুলিশ, কোথায় পুলিশ? সাংবাদিকদের ভিতরে ঢুকতে দেবেন না।”

সব মিলিয়ে সওয়া ঘণ্টার এপিসোড। কিন্তু চারমূর্তির চোখ শুধু মিডিয়ার দিকে। শিল্পীদের কেউ আলোকচিত্রীদের অনুরোধে সামান্য পোজ দিলেও ধাতানি দিচ্ছিলেন অরিন্দম। মিছিল শুরুর মিনিট দশেকের মধ্যেই প্রায় হাতাহাতি বেধে গেল অভিনেতা রাহুল চক্রবর্তীর সঙ্গে। অরিন্দমকে বলতে শোনা গেল, “খুব বাড়াবাড়ি হচ্ছে। তুমি বেশি বোঝ?” রাহুলের পাল্টা, “একদম বেশি কথা বলবে না। তোমায় দেখে নেব।” পাবলিক তখন স্টার ছেড়ে দু’জনের ঝগড়া দেখতে ব্যস্ত। পটাপট মোবাইলে ছবিও উঠছে। শেষমেশ পুলিশ এবং সহকর্মীরা এসে কোনও মতে পরিস্থিতি সামাল দিলেন।

তত ক্ষণে মিছিলের পুরোভাগ থেকে উধাও ইন্দ্রনীল। তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেল মিছিলেন শেষ প্রান্তে। হঠাৎ ব্যাকফুটে কেন? তাঁর জবাব, “অনেক ফোক সিঙ্গার, অখ্যাত শিল্পীরা এসেছিলেন। তাই মিছিল শুরুর পরে পিছনে চলে গেলাম। আমার ভূমিকাটা বেকেনবাওয়ারের মতো। বেকেনবাওয়ার যেমন সুইপারের ভূমিকায় গোটা মাঠ সামলাতেন।”

শ্রীকান্ত মোহতা সামলাচ্ছিলেন ‘টিম ভেঙ্কটেশকে। অনুগত পরিচালক, নির্ভরশীল তারকা, টেলিভিশনের বেশ কিছু উঠতি মুখ তাঁর চার পাশে। আট-দশ জন ‘বাউন্সার’ গোছের লোকও ছিলেন। মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহধন্য প্রযোজক মশাই আকারে-ইঙ্গিতে তাদের নির্দেশ দিচ্ছিলেন, যাতে সাংবাদিক দেখলেই সরিয়ে দেওয়া হয়। নিজেও হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন না। প্রায় সারা রাস্তাই তাঁর দুই কনুই সচল ছিল পুরোমাত্রায়। কেন এই মিছিল? প্রশ্ন শুনে পাত্তা না দেওয়ার ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকলেন অন্য দিকে।

কবি সুবোধ সরকার কথা বলতে ভালবাসেন বরাবর। বাম আমলেও বিভিন্ন ইস্যুতে হাতে-গরম ‘বাইট’ দিতেন, বিরোধীদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পাল্টা মিছিলেও পা মেলাতেন। স্ত্রী-বিয়োগের পর দিদির দলে নাম লিখিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে উচ্ছ্বাস, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কবির উৎসাহ খুবই বেশি। আগের দিনই মিডিয়ার অপপ্রচার নিয়ে সুর চড়িয়েছিলেন। এ দিন মিছিলের সামনের দিকেই থাকলেন। তবে কথা কম। বললেন, “যা বলার মিছিলের শেষে বলব।” রাতে ফোন করায় জানালেন, “খুব ভাল মিছিল হয়েছে, যদিও আপনারা বলবেন খারাপ হয়েছে। সাংবাদিকদের যা ভিড় দেখলাম!”

অরিন্দম অবশ্য ভিড় দেখে আপ্লুত কন্যাকর্তা। নিজেকেই নিজে সার্টিফিকেট দিয়ে বলেছেন, “আমি তো মমতাদির নির্দেশে আহ্বায়ক ছিলাম। কাউকে চাপ দিইনি, তাতেই যা ফিডব্যাক! যারা বলেছিলেন লোক হবে না, তাদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছি।”

মিছিল ফিনিশিং লাইনে পৌঁছনোর আগেই অবশ্য চারমূর্তির দুই মূর্তি উধাও। ইন্দ্রনীল আর সুবোধকে খুঁজে পাওয়া গেল না। নায়ক-নায়িকাদের কয়েক জনকে নিয়ে অরিন্দম হাঁফাতে হাঁফাতে ঢুকে পড়লেন অ্যাকাডেমি চত্বরে। তিন ষন্ডাগন্ডা শাগরেদ নিয়ে দু’হাতে গেট আটকে হুঙ্কার দিতে শুরু করলেন শ্রীকান্ত। সাংবাদিক এবং আলোকচিত্রীদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করছেন “কেউ ঢুকবেন না কেউ না। শুধু অ্যাক্টররা থাকবে। পুলিশ কোথায় পুলিশ? হঠিয়ে দিন সবাইকে।”

‘অ্যাক্টর’দের দলে ভিড়েই ভিতরে গিয়ে দেখা গেল, অ্যাকাডেমির ফোয়ারার সামনে বসে সায়ন্তিকা-নুসরত-পায়েলরা বলছেন, “অরিন্দমদা জল খাওয়ান, আর পারছি না।” অরিন্দম ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “দাঁড়াও দাঁড়াও। এমনিতেই মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।” সিরিয়ালের দুই অভিনেত্রী কাদের যেন টেলিফোনে আকুল হয়ে বলতে লাগলেন, “অ্যাকাডেমিতে আটকে। কী করে বেরোব বুঝতে পারছি না।” দেব বাইরে থেকেই উর্দ্ধশ্বাসে ছুটলেন গাড়ি ধরার জন্য। এক জন বলে উঠলেন, অ্যাকাডেমির হল-এর মধ্যে ঢোকা যাবে না। অনুষ্ঠান হচ্ছে। শ্রীকান্ত জিজ্ঞাসা করলেন, “ব্রাত্য কোথায়?” উত্তর দিলেন না কেউই। অরিন্দম পরিমর্শ দিলেন, “বাইরে যা অবস্থা, গেটের বাইরে যাওয়া যাবে না। পিছনের কোনও দরজা দিয়ে লুকিয়ে বেরোতে হবে।”

শ্রীকান্তের এক সহযোগী এসে নিচু গলায় জানালেন, অ্যাকাডেমি চত্বরের কোনার দিকে যে রেস্তোরাঁ আছে তার ভিতর দিয়ে বাইরের দিকে বেরোনো যাবে। নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে নিয়ে সে দিকে ছুটলেন দুই মূর্তি। রে রে করে তেড়ে এলেন রেস্তোঁরার মালিক। তাঁকে কোনও মতে দু’হাতে ধাক্কা মেরে সদলবল পরিত্রাণের পথ খুঁজে নিলেন অরিন্দম-শ্রীকান্ত জুটি।

টেনিদার ভূমিকায় জাঁকিয়ে রইলেন অরিন্দমই। বাকি তিন জনের কে প্যালা, কে হাবুল, কে ক্যাবলা, সেটাই শুধু স্পষ্ট হল না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE