সিএসটিসি-র গুমটিতে হতশ্রী, জীর্ণ বাস। — সজল চট্টোপাধ্যায়
মাত্র ছ’মাস আগে সিএসটিসি-র ঘরে এসেছিল নতুন ৬৭৫টি বাস। কথা ছিল, নতুন-পুরনো মিলিয়ে কলকাতার রাস্তায় নামবে অন্তত ১১০০টি বাস। সেই পরিকল্পনায় সলতে পাকানোও শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোথায় কী! মাস ছয়েকের মধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়েছে সেই পরিকল্পনা। সরকারি ওই নিগমের হিসেবই বলছে, এখন শহরের রাস্তায় তারা বাস নামাতে পারে মেরেকেটে সাড়ে পাঁচশোর মতো।
কেন? পরিবহণ দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘প্রায় অর্ধেক বাসই তো কোমর ভেঙে পড়ে থাকে। এর মধ্যে মাস ছয়েক আগে আসা নতুন বাসও কিছু রয়েছে। তাই সরকারি প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবের আসমান-জমিন ফারাক হয়ে গিয়েছে।’’
কী রকম? ধরা যাক, সিএসটিসি-র এস-৫ রুট চলে গড়িয়া থেকে হাওড়া পর্যন্ত। এই পথে গড়িয়া ডিপো নিয়মিত ৮টি বাস চালালেও হাওড়া ডিপোর প্রায় কোনও বাসই চলে না। ফলে, ১৬-র জায়গায় ওই রুটে বাস চলে অর্ধেক। আবার, ব্যারাকপুর থেকে বিবাদি বাগ পর্যন্ত এস-১১ রুটে সিএসটিসি-র বাস চলার কথা ২৬টি। চলে আট-দশটা। পরিবহণকর্তারা মানছেন, শহরের সব রুটে ছবিটা কমবেশি এমনই।
আর যাত্রীদের অভিজ্ঞতা হল, মহানগরের রাস্তায় সন্ধ্যা যত রাতের দিকে গড়ায়, সরকারি বাসের সংখ্যাও তত কমতে থাকে। রাত ৮টার পড়ে সরকারি বাস দেখতে পাওয়া প্রায় লটারি জেতার মতোই।
কলকাতা স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএসটিসি)-র ঘরে নতুন বাস আসার আগে পর্যন্ত প্রতি দিন কলকাতায় ওই নিগমের বাস নামত ৪৫০ থেকে ৫৫০টি। গত ছ’মাসে সিএসটিসি-র ঘরে নতুন গাড়ি এসেছে প্রায় ৬৭৫টি। এর মধ্যে জেএনএনইউআরএম প্রকল্পে ৬৩২টি। ওই প্রকল্প ছাড়াও ৩৪টি নতুন বাস কেনা হয়েছে। ছোট ৩২ সিটের বাসও এসেছে ৯টি। সরকারের হিসেব ছিল, পুরনো বাস কিছু বসে গেলেও সিএসটিসি প্রতি দিন অন্তত ১১০০-এর বেশি বাস নামাবে। কিন্তু বাস্তবে তা তো হয়নি। উল্টে, একলপ্তে সিএসটিসি রাস্তায় নামাতে পারে মেরেকেটে ৫৫০।
প্রশ্ন উঠেছে, ৬৭৫টি নতুন বাস কেনার পরেও কেন এই হাল?
সংস্থার শাসক ও বিরোধী— দুই কর্মী ইউনিয়ন এবং অফিসারদের একাংশের মতে, ঠিক পরিচালন নীতির অভাব আর বাস রক্ষণাবেক্ষণে জোর না দেওয়ার ফল ভুগতে হচ্ছে তাঁদের। বাস আছে, কিন্তু বেশির ভাগ বসে আছে। এমনকী, নতুন কেনা অনেক বাস ‘ব্রেক ডাউন’ হয়ে পড়ে থাকলেও কারও ভ্রুক্ষেপ নেই!
সিএসটিসি-র সিটু সমর্থিত কর্মী ইউনিয়নের নেতা রমাপ্রসাদ সেনগুপ্ত আবার বলেন, ‘‘এখানে চালক-কন্ডাক্টদের গড় বয়স ৫৫। চুক্তির ভিত্তিতে নতুন পাঁচশো মতো চালক-কন্ডাক্টর নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। সংস্থা চালানোর কোনও নির্দিষ্ট নীতি নেই। কর্মীদের ঠিক মতো বেতনও হয় না। ফলে, যা হওয়ার তাই হচ্ছে।’’ শাসক-ঘনিষ্ঠ সংগঠনের এক নেতার কথায়, ‘‘কোনও পরিকল্পনা নেই, রক্ষণাবেক্ষণ কার্যত নেই। যা হাল তাতে যে কোনও দিন সংস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে।’’
সিএসটিসি-র এক কর্তার দাবি, ‘‘এখন কর্মীদের বেতনের ২৫ শতাংশ টাকা টিকিট বিক্রি করে তুলতে হয়। হাওড়া, গড়িয়া, মানিকতলা এবং লেক ডিপো থেকেই আমাদের আয়ের ৬০ শতাংশ আসে। তাই এই ডিপোগুলিকে ইচ্ছে মতো রুটে বাস বাড়ানো-কমানোর ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে। অথচ, বাসের মেরামতের দিকে কোনও নজরই নেই। ফলে, বাস একটু খারাপ হলেই বসে যাচ্ছে।’’
সিএসটিসি-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর ভীষ্মদেব দাশগুপ্ত অবশ্য সব অভিযোগ ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর দাবি, ‘‘আগে সাকুল্যে ২০০ বাস রাস্তায় নামছিল। আমরা প্রায় দু’শো পুরনো বাস বিক্রি করে চার কোটি টাকার মতো আয়ও করেছি।’’ নতুন বাস একটিও খারাপ হয়নি বলে দাবি ভীষ্মদেববাবুর।
সংস্থা-প্রধানের দাবি যাই হোক, যাত্রীদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা একেবারেই উল্টো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy