মন যখন বইয়ে। ৪০তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় মঙ্গলবার দেবস্মিতা ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
গানটা বাজলেই স্টল থেকে বেরিয়ে আসছেন অ্যাঞ্জেলা।
কোস্টা রিকা-র ১৯ বছরের এই তন্বী হাল্কা নাচের তালে দুলে দুলে শুনছেন, ‘বই তোমার আমার, বই বন্ধু সবার’!
৪০তম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার নতুন ‘থিম সং’ শুনে মঙ্গলবার বিকেলে লাতিন আমেরিকার অচিন দেশের মেয়ে ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, ‘‘ছন্দটা বেশ লাতিন আমেরিকান মেজাজের।’’ শুনে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল পর্ণাভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বইমেলার এই নতুন গানের সুরকার উত্তেজিত হয়ে জানালেন, বইমেলার ‘থিম কান্ট্রি’ বলিভিয়া বলেই গান বাঁধার সময় প্রচুর লাতিন আমেরিকান ‘ফোক মিউজিক’ শুনেছিলেন। এই গানে লাতিন আমেরিকার বাঁশি ও পারকাশনের প্রয়োগ করেছেন ভেবে-চিন্তেই।
ভাষার ফারাক যা-ই থাক, সুরে সুরে তা হলে মিশে যাচ্ছে কলকাতা-লাতিন আমেরিকা। শুধু গানের সুরেই নয়। মনের সুরেও। বলিভিয়ার কনফারেন্স রুমে রোজই সে-দেশ নিয়ে নানা আলোচনা। স্প্যানিশ শিক্ষার নানা গেম ও টেক্সট মেটিরিয়ালের মতো দ্রষ্টব্যে ভরপুর কোস্টা রিকার স্টলটাও নজর কাড়ে। কলকাতা বইমেলায় মানুষের মহাস্রোতে মুগ্ধ কোস্টা রিকার তিন জনের প্রতিনিধি দল। অ্যাঞ্জেলা, তাঁর মা এলিজাবেথ ও খাবিয়ের। সে-দেশের শিক্ষা জগতের সঙ্গে যুক্ত ওঁরা। স্প্যানিশবিদ দিব্যজ্যোতি মুখোপাধ্যায়ের কাছে খাবিয়ের আফশোস করছিলেন, বিমানে মালপত্রের ওজন এত বেড়ে গেল! নইলে আরও কত কী নিয়ে আসার ইচ্ছে ছিল! মেলায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন যারা, সেই স্প্যানিশ শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েদের আনা মিষ্টি দই খেয়ে অ্যাঞ্জেলার তারিফ আর থামেই না— ‘নাহ্, এমন আইসক্রিম আমাদের দেশেও মেলে না’।
লাতিন আমেরিকার স্বাদও বিচিত্র ভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে কলকাতাকে। চিলের দূতাবাস থেকে এই বইমেলাতেই জন্ম নিয়েছে, সে-দেশের নোবেলজয়ী কবি গাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের কবিতার বঙ্গানুবাদ। জয়া চৌধুরীর অনুবাদে বইটিতে একযোগে মলাট-বন্দি স্প্যানিশ ও বাংলার ভাষান্তর। জিভে-গরম লাতিন স্বাদেরও ঢালাও ব্যবস্থা। মাংসের কাবাবগোত্রের আন্তিচুচো, পোলাও-বিশেষ আরোস তাপাদো বা সসেজ-আলুভাজাময় মুখরোচক সালচি পাপাস সশরীরে মজুত বলিভিয়ার ঘরে। ‘কষে কষা’-র আউটলেটে এ-সব বলিভিয়ান খানা বাঙালির লাতিন আমেরিকান রোমান্স উস্কে দিচ্ছে।
ঘটনাচক্রে বইমেলার বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে এ দিনই সেমিনারের বিষয়, ‘বাঙালিয়ানা ও বৈশ্বিকতা’। বাঙালির বিশ্বনাগরিক হয়ে ওঠা নিয়ে আড্ডায় সামিল লেখক সৈয়দ মনজুরল ইসলাম, ঢাকার বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক সামসুজ্জামান খান, এ পার বাংলার লেখক সমরেশ মজুমদার প্রমুখ। মেলার ‘বাংলাদেশ দিবস’-এরও সূচনা হল, বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর, পশ্চিমবঙ্গের পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য বসু, ঢাকার মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, গণপ্রশাসন মন্ত্রকের সিনিয়র সচিব কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী, সংস্কৃতি সচিব আখতারি মমতাজ প্রমুখের হাত ধরে।
কাছের-দূরের পড়শিকে আমন্ত্রণের আসরে এ পারের বাঙালির নিজস্ব বৌদ্ধিকচর্চাও ব্রাত্য নয়। খোয়াবনামা থেকে প্রকাশিত ‘ঋত্বিক উপনিবেশ’ বইটিতে সংগৃহীত পরিচালক কুমার সাহনি ও ফিল্ম স্টাডিজের শিক্ষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের দুর্লভ আলাপচারিতা। অনলাইন ফোরাম গুরুচণ্ডালীর চটি বই ‘অন্য মহীন’-এ সত্তরের দশকের ছক-ভাঙা গানের দল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র উড়ান-কাহিনি। বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে ইংলিশ চ্যানেল জয়ী প্রতিবন্ধী সাঁতারু মাসুদুর রহমানের স্মরণ সংকলন ‘মাসুদুর এক স্বপ্নের নাম’। সম্পাদনায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর কর্ণধার কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। মেলার মাঠে সুবোধ সরকার সম্পাদিত ‘ভাষানগর’-এর কবিতার গাড়িও দেখা গেল গড়গড়িয়ে চলেছে। একটি ঠেলা ভ্যানের মাথায় মার্বেলগুঁড়োয় সাজানো সুদৃশ্য কবিতা-রথে সওয়ার সুনীল-শক্তি-শঙ্খদের যুগ থেকে জয়-সুবোধ-শ্রীজাত-বিনায়কপর্ব পেরিয়ে তরুণতর কবি-বাহিনী। ‘রোকো’ বলে গাড়ি থামিয়ে কবিতার বই কিনছেন পাঠক-পাঠিকা।
দেশ-বিদেশের বেড়া ভেঙে বইমেলার মাঠে এ ভাবেই ঘরে-বাইরের চিরকালীন হাত-ধরাধরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy