রহস্য: এ ভাবেই উদ্ধার হয় অমিতাদেবীর দেহ (উপরে)। ফাইল চিত্র।
তিনতলার কার্নিসের উপরে দেওয়ালে হেলান দেওয়া অবস্থায় রয়েছে বৃদ্ধার দেহ। তাঁর মাথা বাঁ দিকে হেলানো। গলায় শাড়ির ফাঁস। সেই শাড়ি চারতলার বারান্দার পিছনে জানলার রডের সঙ্গে বাঁধা।
শনিবার সকাল সাতটা নাগাদ নাগেরবাজারের রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডের এক আবাসনে চারতলার বাসিন্দা, আশি বছরের অমিতা দত্তকে এ ভাবে ঝুলতে দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায় গোটা পাড়া! মৃত্যুর ধরন দেখে সকলের মুখে একটাই প্রশ্ন, ঘটনাটি যদি আত্মহত্যাও হয়ে থাকে, তা হলে তার জন্য এ রকম মরিয়া চেষ্টা কেন? মৃতার ছেলে, বৌমা এবং নাতনিকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে দমদম থানার পুলিশ। তাঁর মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখতে দেহটি সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়না-তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রের খবর, এ দিন সকালে প্রাতর্ভ্রমণকারীদের এক জন বৃদ্ধার দেহটি প্রথমে দেখতে পান। খবর ছড়িয়ে পড়ায় মুহূর্তের মধ্যে আবাসনের নীচে লোক জমে যায়। অমিত সেনগুপ্ত নামে এক প্রাতর্ভ্রমণকারী বলেন, ‘‘প্রথমে মনে হয়েছিল, উনি কার্নিসে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।’’
কার্নিসে স্পষ্ট তাঁর পায়ের ছাপ। শনিবার, নাগেরবাজারে। —নিজস্ব চিত্র।
আবাসনের বাসিন্দাদের একাংশ জানিয়েছেন, গত ছ’মাস ধরে চারতলার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া রয়েছে পরিবারটি। অমিতাদেবীর মৃত্যু কী ভাবে হল, তা জানতে চাওয়া হলে ছেলে নীলাঞ্জন জানান, প্রতিদিন তাঁর মা-ই পরিচারিকাকে দরজা খুলে দিতেন। এ দিন সকালে কলিং বেল বেজে যাওয়া সত্ত্বেও কেউ না ওঠায় নীলাঞ্জন দরজা খোলেন। কাজ সেরে যাওয়ার সময়ে পরিচারিকা নীলাঞ্জনকে বলেন, ‘দাদা, মাসিমাকে ঘরে দেখতে পাচ্ছি না।’ এর পরে শৌচাগার ও বাকি দু’টি ঘরে খোঁজার পরে বারান্দায় এসে মায়ের ঝুলন্ত দেহ দেখতে পান তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রশ্ন, মা দরজা খুললেন না দেখেও ছেলের কিছু মনে হল না? পড়শি অমিতবাবু বলেন, ‘‘নিরাপত্তারক্ষীকে দিয়ে বৃদ্ধার ছেলেকে ডেকে পাঠাই আমরা। তার আগে পর্যন্ত তিনি কাউকে কিছু জানাননি!’’ একই বক্তব্য নীলাঞ্জনের ফ্ল্যাটের মালিক এবং ওই আবাসনেরই দোতলার বাসিন্দা রাজু সাউয়ের স্ত্রী ও চারতলার অন্য বাসিন্দাদের। নীলাঞ্জনদের উল্টো দিকের ফ্ল্যাটে থাকেন প্রিয়াঙ্কা সরকার। বললেন, ‘‘মাসিমা খুব হাসিখুশি ছিলেন। মানসিক সমস্যা চোখে পড়েনি।’’ প্রতিবেশীরা জানান, বয়সের তুলনায় সক্ষম ছিলেন অমিতাদেবী। এই পুরো ঘটনাক্রম সকাল সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছয় সওয়া আটটা নাগাদ। দমদম থানায় নীলাঞ্জনের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি মন্তব্য করেননি। পুলিশ সূত্রের খবর, নীলাঞ্জন দাবি করেছেন, আগের রাতে তাঁরা একসঙ্গেই খাওয়াদাওয়া সারেন।
ধোঁয়াশা যেখানে
• আশি বছরের বৃদ্ধার পক্ষে কি চারতলার ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে ঝুলে পড়া সম্ভব?
• নীচে তিনতলার ফ্ল্যাটের কার্নিসে বৃদ্ধার পায়ের ছাপ এত স্পষ্ট কী ভাবে?
• চারতলা থেকে ঝাঁপ দিলে নীচের তলার কেউ কোনও আওয়াজ পাননি?
• সুইসাইড নোটে হাতের লেখা খুব স্পষ্ট। আশি বছরের বৃদ্ধার পক্ষে কি অত স্পষ্ট লেখা সম্ভব?
• দরজা ভেঙে দেহ উদ্ধার করতে হয়নি। বৃদ্ধার ঘরের ও বারান্দার দরজা খোলা ছিল কেন?
• আত্মঘাতী হলে যে সব লক্ষণ দেখা যায়, মৃতার দেহে কি তা মিলেছে?
আদতে কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা অমিতাদেবী এক সময়ে স্কুলে পড়াতেন। বছর তিনেক আগে স্বামীর মৃত্যুর পরে কৃষ্ণনগরে একাই থাকতেন তিনি। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির কাছেই। মাস সাতেক আগে বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। শেষমেশ ছেলের সংসারে ওঠেন। মায়ের জন্য পাইকপাড়ার দু’কামরার ফ্ল্যাট ছেড়ে নাগেরবাজারে তিন কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নেন বলে পুলিশের কাছে দাবি করেছেন নীলাঞ্জন। তাঁর দাবি, অমিতাদেবী প্রায়ই বলতেন, তাঁর অন্তিম সময় এসে গিয়েছে। এ দিন একটি সুইসাইড নোট পেয়েছে পুলিশ। তাতে লেখা, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। সরকারি মতে যেন দেহ সৎকার করা হয়।’
প্রাক্তন পুলিশকর্তাদের বক্তব্য, আত্মহত্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে কয়েকটি বিষয় দেখা জরুরি। প্রথমত, মৃতার মাথা কোন দিকে হেলানো ছিল। এ ক্ষেত্রে ফাঁসের গিঁট যে দিকে, বৃদ্ধার মাথা তার উল্টো দিকে ছিল। মুখ থেকে লালা বেরিয়েছে কি না, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে কি না, মলমূত্র হয়ে গিয়েছে কি না এবং নাকে কফ আটকে রয়েছে কি না, দেখাও জরুরি। লালবাজারের এক কর্তা জানান, এগুলি নির্ভর করছে মৃত্যুর সময়ে বৃদ্ধা কতটা কষ্ট পেয়েছেন, তার উপরে। তবে মৃত্যু ঘরে হয়নি। জানলার সঙ্গে শাড়ি বেঁধে বারান্দার গ্রিল টপকে এ ভাবে ঝুলে পড়ার ঘটনা সত্যিই বিরল। পুলিশ সূত্রে খবর, চারতলার বারান্দায় একটি চেয়ার রাখা ছিল।
ব্যারাকপুর পুলিশ সূত্রে খবর, এ দিন কৃষ্ণনগর থেকে মেয়ে এলেও তিনি অভিযোগ দায়ের করতে চাননি। তাই বৃদ্ধার ছেলে, বৌমা ও নাতনিকে থানায় ডাকা হলেও আটক করা হয়নি। ময়না-তদন্তের রিপোর্টের ভিত্তিতেই পরবর্তী পদক্ষেপ করবে পুলিশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy