রং মেলাতে: শিল্পীর হাতে তৈরি ‘পটের গান’। শনিবার, পার্ক সার্কাস ময়দানে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
তিন দশক আগে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসে এক অসম যুদ্ধ জিতে নিয়েছিলেন তিনি। সড়কপথে ৩৯ দিনে ছ’টি মহাদেশ ঘুরে গিনেস বইয়ে ঠাঁই করে নেন ‘কলকাতার ছেলে’ সালাউদ্দিন ওরফে সালু চৌধুরী।
তখন তাঁর বয়স ৪৭-৪৮ বছর। এখন সত্তরের কোঠায় ঢুকে সালু মজে আছেন ‘জীবনপথে চলার মন্ত্র’ নিয়ে। সাধারণ হিন্দি ও উর্দুভাষীদের জন্য কথ্য হিন্দুস্তানি জবানিতে ‘ভগবত গীতা’র অনুবাদ করে ছাপ ফেলেছেন তিনি। শনিবার সন্ধ্যায় পার্ক সার্কাস ময়দানে রাজ্য সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের উদ্যোগে সেই বইটিকেই মেলে ধরা হল।
সংখ্যালঘু সমাজের কৃতীদের ক্ষমতায়নের নমুনা মেলে ধরার উদ্যোগ এই মিলনমেলা-য় সালু বললেন, ‘‘সব গাড়ির সঙ্গেই তা চালানোর ‘ম্যানুয়াল’ থাকে। গীতা আমার কাছে ধর্মগ্রন্থ নয়। জীবনপথে চলার ম্যানুয়াল।’’ এ রাজ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মেলবন্ধনের ছবিটা তুলে ধরতেও সালুর এই কাজের আলাদা গুরুত্ব বলে মনে করেন রাজ্যসভার সদস্য মহম্মদ নাদিমুল হক। মিলন মেলা-র যে থিম প্যাভিলিয়নে এ দিন সালুর এই প্রয়াসটি নিয়ে কথা হচ্ছিল, সেখানে বাংলার ইতিহাসে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের গল্পই নানা ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। মধ্যযুগের বাংলায় সুলতানি আমলে মুসলিম শাসকেরাই মহাভারত অনুবাদে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। পয়ার ছন্দে ‘গৌড়ের ঈশ্বর’ হুসেন শাহের প্রশস্তির কথাও ঢুকে পড়েছিল সে যুগের মহাভারতে। আবার গিরিশচন্দ্র সেনের বাংলা ভাষান্তরের কোরান কিংবা মুসলিম নৌকাচালকের মেয়েকে স্বামী বিবেকানন্দের ‘কুমারীপুজো’র কথাও বলা হয়েছে থিম প্যাভিলিয়নের সাজসজ্জায়। সেখানে বসেই সালু চৌধুরী বলছিলেন তাঁর গীতা-প্রীতির কথা।
আরও পড়ুন: অভিযোগ ‘সাজানো’, দাবি অন্য মা-বাবাদের
তাঁর আফশোস, দেশভাগের জেরে সাহিত্য-সংস্কৃতির কত পুরোধা আলাদা দেশে ভাগ হয়ে গেলেন! গত শতকে গীতার উর্দু অনুবাদকদের মধ্যে খাজা আব্দুল হাকিম যেমন পাকিস্তানে গিয়েও জীবনভর ‘হিন্দোস্তাঁ’র কথা ভেবে হা-হুতাশ করেছেন। তাঁর গীতা হাকিম সাহেবের মৃত্যুর পরে এ দেশেই প্রকাশিত হয়েছিল। সালুর মতে, আগের উর্দু অনুবাদগুলিতে ফার্সির প্রভাব বেশি। তা আমজনতার বোধগম্য নয়। তাই কথ্য ভাষায় জোর দিয়েছেন তিনি। সংস্কৃত পণ্ডিতদের মুখে বারবার সব শ্লোক শুনে হিন্দি-উর্দু-ইংরেজির অজস্র অনুবাদ পড়ে কাজটা করেছেন। আবার গীতার কাব্যসুষমাও অটুট রাখতে চেয়েছেন। পুরাণ-মহাকাব্য বিশারদ, সংস্কৃতজ্ঞ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী খুশি হয়ে বলেন, ‘‘পরস্পরকে বোঝার স্বার্থেই বিভিন্ন ধর্মের মানুষের উচিত পরস্পরের বই পড়া। এটাই সময়ের দাবি।’’
আর সালু চৌধুরী বলছেন, ‘‘গীতার নিরাকার, একমেবাদ্বিতীয়ম ঈশ্বরভাবনা বড় সুন্দর! নিষ্কাম কর্মের ভাবনাও আমায় টানে।’’ পার্ক সার্কাসে মিলন মেলার আসরে তখন পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার নয়াগ্রামের নাজরা চিত্রকর মনসা, শ্রীকৃষ্ণের পটের গান শোনাচ্ছেন ইংরেজি অনার্স পড়ুয়া শবনম খাতুন বা আরবি অনার্সের ছাত্রী মনীষা সুলতানাদের। সংস্কৃতির ঐক্যের টানেই ধর্মীয় বিভাজনের দেওয়াল তখন অবান্তর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy