প্রসেনজিৎ দে ও আদর্শ তিওয়ারি। ফাইল চিত্র।
রবিবার রাত দুটো।
সুভাষগ্রামে দিদির শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরছি। থাকি ঢাকুরিয়ায়। মোটরবাইকে চালকের আসনে আমি, পিছনে বন্ধু আদর্শ তিওয়ারি। গরফার সাঁপুইপাড়া মোড়ে সিগন্যালে দাঁড়াতেই আমাদের ডান পাশ ঘেঁষে দু’টি গাড়ি এসে থামল। একটি সামনে, অন্যটি পিছনে। হঠাৎ দেখি, পিছনের গাড়ি থেকে এক মহিলা নেমে এসে সামনের গাড়ির চালকের সঙ্গে তর্কাতর্কি জুড়ে দিলেন। কিছু নিয়ে একটা ঝামেলা হয়েছে। মহিলা ওই গাড়ির বাঁ দিকের সামনের দরজা খুলে কিছু একটা বলতে গিয়েছিলেন। হঠাৎ সেই গাড়ির চালক তাঁর ডান হাতে ধরে হেঁচকা টান মারল। পরমুহূর্তেই দেখলাম, মহিলার শরীরের কিছুটা গাড়ির মধ্যে, বাকিটা বাইরে। প্রাণভয়ে তিনি চিৎকার করছেন। ওই অবস্থাতেই সিগন্যাল সবুজ হওয়ায় চলতে শুরু করল সেই গাড়ি। চালক সাঁপুইপাড়া মোড় থেকে ডান দিকে ঘুরে গতি বাড়িয়ে দিল। এমন অবস্থায় কী করা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না। শুধু এটুকু বুঝে যাই, ওই মহিলা বড় বিপদে পড়েছেন। যে কোনও সময়ে গাড়ি থেকে পড়ে যেতে পারেন তিনি। আমি আর দেরি না করে বাইক স্টার্ট দিলাম। বাড়ির পথ না ধরে ছুটলাম ওই গাড়ির পথে।
রাস্তা খুব চওড়া না হওয়ায় চালক গাড়ির গতি বাড়াতে পারছিল না। সরু রাস্তায় কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই আমি মোটরবাইকের গতি বাড়াতে থাকি। সাঁপুইপাড়া মোড় থেকে প্রায় ৫০০ মিটার যাওয়ার পরে একটি ল্যাম্পপোস্টের সামনে গাড়ির গতি কিছুটা কমতেই মোটরবাইকের গতি বাড়িয়ে সোজা গাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াই আমরা। গাড়ি থামতেই ওই মহিলা কোনও ক্রমে বেরিয়ে আসেন। তা দেখে ওই চালকও গাড়ি থেকে নেমে এসে মারতে শুরু করে তাঁকে। আমরা দুই বন্ধু ছুটে গিয়ে ওই লোকটিকে আটকানোর চেষ্টা করতে উল্টে সে আমাদেরও মারতে শুরু করে। আমরাও তখন পাল্টা হাত চালাই। বুঝতে পারছিলাম, ওই চালক পুরোপুরি নেশাগ্রস্ত। মুখ দিয়ে ভকভক করে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। হাতাহাতির এই দৃশ্য দেখে স্থানীয় চার-পাঁচ জন যুবক ছুটে আসেন। ঘটনার কথা শুনে আমাদের বিষয়টি মিটিয়ে নিতে বলেন তাঁরা। আমরা তখন ওঁদের বলি, ওই চালক মহিলার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মাঝরাতে এক মহিলাকে ওই ভাবে হেনস্থা হতে দেখেও স্থানীয় যুবকেরা অভিযুক্ত চালককে ধরে পুলিশে দেওয়ার কোনও চেষ্টাই করলেন না। তাকে ছেড়ে দেওয়া হল। আর সে-ও দিব্যি গাড়ি চালিয়ে পালিয়ে গেল।
চালক গা়ড়ি নিয়ে পালালেও ওই মহিলার সঙ্গে কথা বলে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, গোটা ঘটনাটি পুলিশকে জানানো হবে। ঠিক করি, তিন জনে মিলে যাদবপুর থানায় যাব। সাঁপুইপাড়া মোড় থেকে গাড়ি নিয়ে আসতে গিয়ে ওই মহিলার স্বামীও তখন রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন।
তিনি ফোন করেন স্ত্রীকে। আমরা তাঁকেও যাদবপুর থানায় পৌঁছে যেতে বলি। আমি ও আদর্শ ওই মহিলাকে নিয়ে প্রথমে যাদবপুর থানায় গিয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলি। পরে গরফা থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়।
আমি কলকাতার এক স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ি। আদর্শ একাদশ শ্রেণির ছাত্র। আমরা কেউই জীবনে কোনও দিন এমন কোনও অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হইনি। বর্ষবরণের রাতে সুনসান রাস্তায় এক অপরিচিত মহিলার ওই হেনস্থা দেখে আমার কেন জানি না, নিজের দিদির মুখটা মনে পড়ে গিয়েছিল। দিদির বাড়ি থেকেই তো ফিরছিলাম। ওর বয়সও ওই মহিলার মতোই। বাইক নিয়ে গাড়িটাকে যখন ধাওয়া করেছিলাম, একটুও ভয় করেনি বললে মিথ্যে বলা হবে। তবে ওই মুহূর্তে এক মরিয়া জেদও চেপে বসেছিল আমাদের মধ্যে। চোখের সামনে এক মহিলাকে এ ভাবে হেনস্থা করবে, আর আমরা দাঁড়িয়ে দেখব? ভাবলাম যা হয় হোক, শেষ দেখে তবে ছাড়ব। আর সাতপাঁচ ভাবিনি। দুই বন্ধু মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ি ওই মহিলাকে বাঁচাতে।
মা-বাবা ভয় পেতে পারেন, এমন আশঙ্কা থেকেই সেই রাতে বাড়ি ফিরে কিছু বলিনি। মঙ্গলবার তাঁরা কাগজ পড়ে সব জানতে পারেন। দু’জনের হাসিই এখন বলে দিচ্ছে, ছেলের এই কাজে কতটা গর্বিত ওঁরা। আমার আর আদর্শের জীবনেও এই ঘটনা এক বড় শিক্ষা। আবার যদি কখনও এমন কিছু ঘটতে দেখি, একই ভাবে রুখে দাঁড়াব আমরা। একসঙ্গেই হোক, বা একা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy