Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

সেতু নির্মাণে সাব কন্ট্রাক্ট সঞ্জয় বক্সির ভাইপোকে, জড়াচ্ছে তৃণমূলের নাম

ভাঙল উড়ালপুল। মজবুত হলো পাইয়ে দেওয়ার তত্ত্ব!জানা গেল, উড়ালপুলের যে অংশ ভেঙেছে, তার সাব-কন্ট্রাক্ট পেয়েছিল সন্ধ্যা এন্টারপ্রাইজ। মালিক রজত বক্সী স্থানীয় তৃণমূল নেতা সঞ্জয় বক্সীর ভাইপো। সঞ্জয়ের স্ত্রী স্মিতা বক্সী ওই এলাকারই বিধায়ক।

রজত বক্সী

রজত বক্সী

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:০৬
Share: Save:

ভাঙল উড়ালপুল। মজবুত হলো পাইয়ে দেওয়ার তত্ত্ব!

জানা গেল, উড়ালপুলের যে অংশ ভেঙেছে, তার সাব-কন্ট্রাক্ট পেয়েছিল সন্ধ্যা এন্টারপ্রাইজ। মালিক রজত বক্সী স্থানীয় তৃণমূল নেতা সঞ্জয় বক্সীর ভাইপো। সঞ্জয়ের স্ত্রী স্মিতা বক্সী ওই এলাকারই বিধায়ক।

ঘটনাচক্রে শুক্রবারই প্রকাশিত হয়েছে নারদ-কাণ্ডের আর এক দফা ফুটেজ। যেখানে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম তাঁর দলীয় সতীর্থ ইকবাল আহমেদের কাজ পাইয়ে দেওয়ার আবদারের উত্তরে বলছেন, ‘‘কেএমডিএ-র বড় বড় কাজ আছে। তুমি করো না কেন? তুমি ফেলো টেন্ডার। আমি করিয়ে দেব।’’

কাট টু: চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের মন্ত্রী শশী পাঁজার বাড়ির ঠিক উল্টো দিকের অপরিসর গলি। ৫১এ, গিরিশ পার্ক নর্থ ঠিকানার বাড়ির গায়ে লটকানো নেম প্লেটে সন্ধ্যা এন্টারপ্রাইজ আর রজত বক্সীর নাম। সেই অফিস ঘর অবশ্য এ দিন বন্ধ। স্থানীয়রা জানালেন, এই অফিস থেকেই রজতের কাঁচামাল সরবরাহের ব্যবসা চলত। বৃহস্পতিবার ঘটনা ঘটার আগেও অফিস খোলা ছিল। তার পর শাটার বন্ধ হয়ে যায়।

আরও পড়ুন: এই থামের ওপর সেতু, শিউরে ওঠেন ইঞ্জিনিয়ার

স্থানীয় বাসিন্দারাই জানাচ্ছেন, রজত নামে মাত্র। তাঁর আড়ালে ব্যবসাটা আদতে সঞ্জয়-স্মিতার। শুধু এই একটা নয়, অন্তত দশটি সংস্থার নামে ঠিকাদারি ব্যবসা চালান বক্সী দম্পতি। পাশাপাশি বেআইনি নির্মাণ, বেশি দামে দেশি মদ বিক্রি, বাংলাদেশি মহিলাদের নিয়ে ব্যবসা— বেনামে সঞ্জয় এমন বহু কারবার চালান বলে শোনা যাচ্ছে এলাকায় কান পাতলেই। যা নিয়ে পুরসভায় এবং লালবাজারে অভিযোগ হয়েছে। এ দিন বহু চেষ্টা করেও সঞ্জয়ের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। আর জোড়াবাগান কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী স্মিতাদেবী বলেন, ‘‘রজত আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। আমাদের এ রকম অনেক আত্মীয় আছে। রজত কী ভাবে ওই কাজের বরাত পেয়েছিল, জানি না। আমার প্রভাবে পেয়েছিল, এটা প্রমাণ হলে রাজনীতি ছেড়ে দেব।’’ রজতও বলেন, ‘‘পদবী এক হওয়ার জন্যই এমন অভিযোগ উঠছে। কাকার সঙ্গে আমার বছরে এক-দু’বার যোগাযোগ হয়।’’

ঘটনাস্থলে মেয়রের সঙ্গে সঞ্জয় বক্সী।

যদিও তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘পুরসভা এবং সরকারকে হাতে রেখে কারা ওই এলাকায় উড়ালপুলের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল, স্থানীয় মানুষের অনেকেই তা জানেন। বাম জমানায় উড়ালপুলের কাজ শুরু হওয়ার কথা বলা হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু তাতে কি আর ক্ষতি সামাল দেওয়া যায়?’’ ববি অবশ্য এ দিন দাবি করেন, ‘‘শপথ করে বলছি, এই রজত কে, আমি জানি না। তাঁকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রশ্নই নেই।’’ যদিও বিরোধীদের অভিযোগ,

কাজ পাইয়ে দেওয়ার সূত্রে যে টাকা আদায় হয়, তার বড় অংশ পৌঁছে যায় শাসক দলের শীর্ষ স্তরে। যা শুনে ববির মন্তব্য, ‘‘চ্যালেঞ্জ করছি, এমন কথা কেউ প্রমাণ করুক।’’ বিরোধীরা পাল্টা বলছেন, নারদ ভিডিওই তো তার প্রমাণ!

বিবেকানন্দ উড়ালপুলে ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে বছর পাঁচেক ধরে যুক্ত সন্ধ্যা এন্টারপ্রাইজ। সাব কন্ট্রাক্টর হিসাবে প্রথমে তারা সিমেন্ট ও লোহা সরবরাহ করত। পরে শ্রমিক সরবরাহের বরাত পায়। দুর্ঘটনার আগের রাতে পুলের যে অংশে ঢালাই হয়েছিল, সেটিই ভেঙে পড়ে। সেই কাজে যুক্ত ছিল রজতের সংস্থা।

কুলগোত্রহীন সন্ধ্যা এন্টারপ্রাইজকে কেন উড়ালপুল তৈরির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে যুক্ত করা হয়েছিল, সেই প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে। এ দিন হাওড়ার মন্দিরতলার বাড়িতে বসে রজত নিজেই জানান, তাঁর অভিজ্ঞতা বলতে বিহারে মাটির তলায় অপটিক্যাল ফাইবার পাতা এবং রাজারহাটে মেট্রোর জন্য মাটি সরানোর কাজে শ্রমিক সরবরাহ করা।

রজতের দাবি, এই উড়ালপুলের কাজে সরাসরি যোগাযোগ তাঁর ছিল না। তিনি স্রেফ শ্রমিক সরবরাহ করেছেন। মালমশলা নয়। তাঁর কথায়, ‘‘আমার শ্রমিকরা ঢালাই করেননি। মূল ঠিকাদার সংস্থার রুবির অফিস থেকে ঢালাইয়ের মশলা (রেডিমিক্স) আসত। সংস্থার সুপারভাইজারদের নজরদারিতে পাইপে করে তা উপরে তুলে তা ঢেলে দেওয়া হতো। এই কাজে শ্রমিকরা সাহায্য করতো। সে দিনও তাই হয়েছিল।’’

কিন্তু এলাকার বিরোধী নেতা এবং স্থানীয় মানুষদের একাংশ বলছেন, গত বছর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাড়া দিতেই নভেম্বর-ডিসেম্বরে উড়ালপুলের কাজ নতুন করে শুরু হয়। নির্মীয়মাণ সেতুর নীচে একটি মন্দির ছিল। তা ভাঙা নিয়ে চাপানউতোরের হাত ধরেই সেতুর কাজে ঢুকে পড়ে বক্সী-বাহিনী। তারা সিমেন্ট ও বালি সরবরাহ এবং তাদের শ্রমিক দিয়ে কাজ করাতে বাধ্য করে। কেএমডিএ সূত্রের খবর, বক্সী-বাহিনীর দাপট বাড়তে থাকলেও কেএমডিএ কর্তৃপক্ষ নীরব থেকেছেন। কাঁচামাল নিয়ে অভিযোগ থাকলেও চুপ থেকেছেন সরকারি কর্তারা। স্থানীয় একাধিক তৃণমূল নেতার দাবি, উড়ালপুল তৈরি নিয়ে নানা অভিযোগ নবান্নে জানানো হয়েছে। লাভ হয়নি। বলা হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী চান ওই সেতু দ্রুত তৈরি হোক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE