ঘটনার পরে অভিযুক্ত দু’দিন বাড়িতে বসে রইলেন। গ্রেফতার তো দূর, একটি বারের জন্যও তাঁকে জেরা করা হল না। অথচ অভিযোগকারীকে নিয়ে চলল দড়ি টানাটানি! লালবাজারের এ হেন আচরণের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিপত্তির প্রভাব দেখছেন নিচুতলার পুলিশকর্মীদের বড় অংশ। সাদৃশ্য হিসেবে উঠে আসছে সাম্প্রতিক অতীতের কিছু ঘটনার প্রসঙ্গও।
অভিযুক্ত হলেন দেবপ্রিয়া চট্টোপাধ্যায়, সম্পর্কে যিনি কিনা কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ভাইঝি। আর অভিযোগকারী কলকাতা পুলিশের ট্র্যাফিক কনস্টেবল চন্দন পাণ্ডে, কর্তব্যরত অবস্থায় শুক্রবার রাতে যাঁকে হেনস্থার জন্য আঙুল উঠেছে দেবপ্রিয়ার দিকে। কিন্তু মেয়রের ভাইঝিকে ছেড়ে পুলিশকর্তারা আপাতত চন্দনবাবুকে নিয়েই পড়েছেন। জেরার ঠেলায় তিনি জেরবার। রবিবার ছুটির দিনেও তাঁকে থানায় তলব করে অভিযোগের ‘সত্যতা’ যাচাইয়ের খাতিরে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
শুক্রবার রাতে দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে সিগন্যাল ভেঙে বেপরোয়া গাড়ি চালানো, পথচারীকে ধাক্কা মারা ও পুলিশের কাজে বাধাদানের অভিযোগে ওই রাতেই মেয়রের ভাইঝির নামে নালিশ দায়ের করেছিলেন চন্দনবাবু। কিন্তু টালিগঞ্জের ট্র্যাফিক গার্ডের ওই কনস্টেবলকে যে ভাবে কর্তব্য পালনের খেসারত দিতে হচ্ছে, তা দেখে সহকর্মীদের অনেকেই ক্ষুব্ধ ও হতাশ। মাস কয়েক আগে লেকটাউনের মোড়ে ঘটে যাওয়া একই রকমের একটি ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিয়ে ওঁদের আক্ষেপ, অভিযোগ যা-ই থাক না কেন, প্রভাবশালীদের না-ছোঁয়াটাই যেন এ রাজ্যের পুলিশের দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে! নিচুতলার মতে, লেকটাউন-কাণ্ডের মতো এটিরও ধামাচাপা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ষোলো আনা।
কী হয়েছিল লেকটাউনে?
মাস কয়েক আগে লেকটাউনের মোড়ে ট্র্যাফিক-আইন ভাঙায় হাওড়ার তৃণমূল সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ি থামিয়েছিলেন এক ট্র্যাফিক কনস্টেবল। অভিযোগ, রুষ্ট সাংসদ গাড়ি থেকে নেমে সপাটে তাঁর গালে চড় কষিয়ে দেন। জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের হলেও বিধাননগর কমিশনারেট সাংসদকেও এক বারও জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। তবে ‘তদন্তের স্বার্থে’ অভিযোগকারীকে বারবার ডেকে পাঠিয়েছে। তাঁকে ঘটনাস্থলে নিয়ে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা হয়েছে, তিনি আদৌ সত্যি বলছেন কি না।
বস্তুত লেকটাউনের ক্ষেত্রে বিধাননগর কমিশনারেট প্রথমে অভিযোগ নিতেই চায়নি। পরে নিচুতলার ক্ষোভের আঁচ পেয়ে সংশ্লিষ্ট কনস্টেবলকে ডেকে এনে অভিযোগ লেখানো হয়েছিল। চন্দনবাবুর ক্ষেত্রেও তেমনটা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তবে তা হতে পারেনি প্রত্যক্ষদর্শীদের দৌলতে। চন্দনবাবুর এক সহকর্মীর কথায়, ‘‘ঘটনার বেশ কিছু প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। মূলত তাঁদের চাপেই টালিগঞ্জ থানার অফিসারেরা অভিযোগ লিখেছেন। না হলে আদৌ কেস হতো কি না, যথেষ্ট সন্দেহ।’’ মহিলা মেয়রের ভাইঝি জেনেও চন্দনবাবু যে রণে ভঙ্গ দেননি, সে জন্য তাঁকে বাহবাও দিচ্ছেন সতীর্থেরা।
‘কেস’ একটা হয়েছে বটে। তবে তার পরিণতি সম্পর্কে নিচুতলার পুলিশমহল খুব আশাবাদী হতে পারছে না। উল্টে মেয়রের ভাইঝিকে যে ভাবে ‘আড়াল করার’ চেষ্টা হচ্ছে, তাতে উঠে আসছে লেকটাউন-তদন্তের অপমৃত্যুর প্রসঙ্গ। ‘‘মামলাটা বলতে গেলে ধামাচাপাই পড়ে গিয়েছে। এমপি-কে জেরা করা হয়নি। তিনি অভিযোগকারীর মানসিক সুস্থিতি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কমিশনারেটও কার্যত তাল মিলিয়ে গিয়েছে।’’— খেদ এক পুলিশকর্মীর।
মেয়রের ভাইঝিও চন্দনবাবুর বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়া ও দুর্ব্যবহারের অভিযোগ এনেছেন। লালবাজার তাকেই বেশি গুরুত্ব দেবে কিনা, সে নিয়ে জল্পনা চলছে। প্রশ্ন উঠছে, কোনও আইনভঙ্গকারীকে ধরতে লালবাজারের অনুমতি লাগবে কেন?
চন্দনবাবু কী বলছেন? রবিবার চন্দনবাবুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা হলে তাঁর বাড়ি থেকে বলা হয়, ওঁকে অফিসে ডেকে পাঠিয়েছে, তাড়াহুড়োয় মোবাইল নিতে ভুলে গিয়েছেন। সন্ধ্যায় চন্দনবাবুকে ধরা গেলেও প্রশ্ন শুনে তিনি ফোন কেটে দেন। ফোন বন্ধ হয়ে যায়। টালিগঞ্জ ট্র্যাফিক গার্ডে খোঁজ করতে গেলে চন্দনবাবুর সহকর্মীরা হাত জোড় করে বলেছেন, ‘‘ওকে আর বিপদে ফেলবেন না। আইন বাঁচাতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেল। হয়তো বদলির গুঁতো সামলাতে হবে।’’
দেবপ্রিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা হলে তাঁকেও পাওয়া যায়নি। তাঁর বাবা, অর্থাৎ মেয়রের দাদা চন্দন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আপনাদের উপরে বিশ্বাস নেই। কোনও কথা বলব না।’’ মেয়র শোভনবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘যা বলার, শনিবার বলে দিয়েছি।’’ শনিবার মেয়র বলেছিলেন, ‘‘আইন আইনের পথে চলবে। আমি পুলিশের কাজে হস্তক্ষেপ করিনি। করবও না।’’ তা পুলিশকর্মীকে নিগ্রহের অভিযোগ নিয়ে পুলিশ কর্তৃপক্ষ কী করছেন?
প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেফতারের প্রয়োজন তাঁরা দেখছেন না। লালবাজারের এক কর্তা এ দিন বলেন, ‘‘টালিগঞ্জ থানাই তদন্ত করছে।’’ লালবাজার জানিয়েছে, তদন্ত সেরে কোর্টে চার্জশিট জমা দেওয়া হবে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি-র ফুটেজ দেখা হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।
নিগৃহীত কনস্টেবলকে নিয়ে যেমন টানা-হ্যাঁচড়া চলছে, তাতে প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশের ডাকে সাড়া দেবেন কি না, সে বিষয়ে নিচুতলা সন্দিহান। ‘‘ চন্দনের কপালেই বোধহয় আরও ভোগান্তি রয়েছে।’’— বলছেন এক সহকর্মী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy