Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
পণ্ডিতিয়া-অশ্বিনী দত্ত রোড

চারপাশ সুন্দর রাখার সচেতনতা কই

একটা পাড়া সুন্দর হয়ে ওঠে সেখানকার বাসিন্দাদের হাত ধরে। তারা যদি সাজিয়ে রাখে, গুছিয়ে রাখে, পরিচ্ছন্ন করে রাখে, তবে পাড়াটা আপনা থেকেই ছবির মতো হয়ে যায়। সচেতনতার এই বোধটা বড্ড জরুরি। অশ্বিনী দত্ত রোডের এ পাড়াটায় পঁয়তাল্লিশ বছর কাটিয়ে ফেলে সে কথা হাড়ে হাড়ে বুঝেছি।

অনুপম দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৫ ০০:৩২
Share: Save:

একটা পাড়া সুন্দর হয়ে ওঠে সেখানকার বাসিন্দাদের হাত ধরে। তারা যদি সাজিয়ে রাখে, গুছিয়ে রাখে, পরিচ্ছন্ন করে রাখে, তবে পাড়াটা আপনা থেকেই ছবির মতো হয়ে যায়। সচেতনতার এই বোধটা বড্ড জরুরি। অশ্বিনী দত্ত রোডের এ পাড়াটায় পঁয়তাল্লিশ বছর কাটিয়ে ফেলে সে কথা হাড়ে হাড়ে বুঝেছি।

পুরসভার জঞ্জালের গাড়ি আসে দিনে দু’তিন বার। যেই গাড়িটা বেরিয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে কারও বাড়ির দোতলার জানলা থেকে ধপাস করে নীচে এসে পড়ল আবর্জনা ঠাসা থলি। সে সব ছড়িয়েছিটিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা ফের নোংরা। কই বিদেশে তো এমন হয় না? সেখানে রাস্তায় দু’পা দূরে দূরে ভ্যাট। রাস্তায় পড়ে থাকা সিগারেটের টুকরো দেখলেও যে কেউ তা কুড়িয়ে সেখানে ফেলে আসেন। এখানে তার প্রয়োজনীয়তাটা কেন বুঝবেন না কেউ? নিজেরা সচেতন না হলে পুরসভাই বা এলাকাটাকে পরিচ্ছন্ন রাখবে কী করে? পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর তো আর তাদের পক্ষে জঞ্জাল কুড়িয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়! তবে হ্যাঁ, পুরসভার সাফাইকর্মীদের আরও একটু সক্রিয় হতে হবে।

নিজেদের বাড়িগুলোকেও তো একটু সাজিয়েগুছিয়ে রাখা যায়। পুরনো পুরনো সব বাড়ি— তার এখানে-ওখানে ভাঙাচোরা, ধুলো জমেছে, রং চটে গিয়েছে। প্রত্যেকে সচেষ্ট হয়ে নিজের বাড়িটুকুর একটু যত্ন নিলেই গোটা পাড়াটাই সুন্দর হয়ে উঠতে পারে। বিদেশের বাড়ি, রাস্তাগুলোর মতো ঝকঝকে লাগবে নিজের পাড়াটাই। সেটাই বা কবে বুঝবেন এখানকার মানুষ?

ইংল্যান্ড-আমেরিকায় যে জিনিসটা আমায় সবচেয়ে বেশি টানে, তা হল নিস্তব্ধতা। অহেতুক হর্ন নেই, অকারণ চেঁচামেচি নেই। নিরিবিলিতে, নিজের মতো করে সময় কাটাতে পারার সেই সুযোগ সৃষ্টিশীলতাকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। আর আমার পাড়ায়? গভীর রাত পর্যন্ত গাড়িঘোড়া, রাস্তা ধরে যেতে যেতে অকারণ জোরে কথাবার্তা, সেই সঙ্গে কুকুরের তুমুল চিৎকার তো আছেই। এতগুলো বছর কেটে গেল, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলাম না এ পাড়ার কুকুরেরা ঠিক রাত তিনটে বাজলেই চিৎকার জোড়ে কেন! আর সেই সঙ্গে পুজো, বিয়ে নানা উপলক্ষে যখন-তখন শোভাযাত্রা আছে, তার মাইক আছে, বাজি-পটকার উল্লাস আছে। আপনার আনন্দ যেন অন্যের নিরানন্দের কারণ না হয়, সেটা মাথায় রাখাও কিন্তু জরুরি। আর আছে রাজনৈতিক সভা। সামনেই তিন মাথার মোড়ে ত্রিধারা কর্নারটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মিটিং করে। সেই লাউডস্পিকার বক্স বসে পাড়ার বাড়িগুলোর সামনে। নিয়মকানুনকে দিব্যি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাত ১০টার ঢের বেশি দেরি পর্যন্ত চলে সে সব সভা। পুলিশকে বলেও কোনও লাভ হয় না। কেউ কিছু বলে না।

এখানকার আর একটা বড় সমস্যা নেশাখোরদের ঠেক। একটু রাত বাড়লেই গাছতলাগুলোতে দেশি মদের দোকান ঝাঁপ খোলে। আশপাশের বস্তির ছেলেরাই মূলত তার খদ্দের। গভীর রাত পর্যন্ত পাউচ নিয়ে বসে জমিয়ে নেশা চলে পাড়ার রকগুলোতে। সঙ্গে তুমুল উল্লাস। পুলিশের টহলদার গাড়ি দেখলে, ক্রেতা-বিক্রেতা সব নিমেষে হাওয়া। গাড়ি চলে গেলেই ফের যে-কে-সেই। আর সেই নেশার টাকা জোগাতে ছিঁচকে চুরিও লেগেই থাকে, এর বাড়ির বাল্‌ব, ওর বাড়ির তালা যখন-তখন উধাও হয়ে যায়। আমরা নিজেরা নাইটগার্ড রেখেছি, সে-ও এখন বাঁশি বাজিয়ে আসে! বাঁশির শব্দ শুনে সজাগ হয়ে চোর তো আগেই পালাবে! ধরবে কী করে!

তবে হ্যাঁ, বছর ১০-১৫ হল, এ পাড়ায় বড় চুরি-ডাকাতি বা অন্য অপরাধ হয় না আর। রাজনৈতিক গোলমাল লেগেই আছে অবশ্য, তবে তার জেরে আগের মতো নিত্য খুন-জখম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু পুলিশকে নজরদারি আরও বাড়াতে হবে।

ভাল কাজ করছেন এখানকার কাউন্সিলর দেবাশিস কুমারও। সাধ্যমতো সব রকম পরিষেবার মান উন্নত করেছেন। রাস্তাঘাটে আর খানাখন্দ নেই তেমন। যথাসম্ভব সাফসুতরো রাখার চেষ্টা করেন গোটা পাড়াটাকে। পাড়ায় পানীয় জলের ব্যবস্থাও ভাল হয়েছে। তবে পুরসভার কল থেকে জলের অপচয়টা বন্ধ করতে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। রাস্তা সারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিজের প্রয়োজনে খুঁড়ে ফেলার মতো অভ্যাসটাও পাল্টাতে হবে। যথাসম্ভব গাছও বসাচ্ছে পুরসভা। কিন্তু গরুতে খেয়ে যাচ্ছে, বড় প্রতিমা নিয়ে যাওয়ার সময়ে ডালপালা কেটে দেওয়া হচ্ছে নির্বিচারে। ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেই গাছগুলোকে বাঁচানো যাচ্ছে না সে ভাবে। আর একটু বৃষ্টিতেই এখানে জল জমে। জল নামতে নামতে ছ’সাত ঘণ্টা। এটা বদলাতে হবে। তবে পুরসভার যে দিকটায় বেশি করে নজর দেওয়া জরুরি, তা হল মশার উৎপাত বন্ধ করা। এ পাড়ায় ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ দেখা দেয় মাঝেমধ্যেই। সেটা বন্ধ করতে ঠিক মতো ব্যবস্থা নিতে হবে। নিয়মিত ওষুধ স্প্রে, ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসার ব্যবস্থা যথাযথ রাখার বিষয়টায় খেয়াল রাখতে হবে।

এ পাড়ায় কয়েকটা জিনিস বেশ ভাল। সপ্তাহে চার দিন ত্রিধারা ক্লাবে মেডিক্যাল ক্যাম্প চালাই আমরা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধপত্রের সিংহভাগই দেওয়া হয় বিনামূল্যে। আরও ডাক্তারদের পাশে পেলে সপ্তাহে সাত দিনই ওই ক্যাম্পটা চালানো যেত। বিনামূল্যে নিয়মিত সব ধরনের টিকাকরণের ব্যবস্থাও করতে চাই আমরা। আর খুলতে চাই একটা ফ্রি লাইব্রেরি। যেখানে দুঃস্থ ছেলেরা নিখরচায় পড়ার বই পাবে, পাড়ার মহিলাদের নিয়ে প্রাইভেট টিউশনের ব্যবস্থা করার চেষ্টাও চলছে। সামান্য টাকার বিনিময়ে বয়স্কদের মাসিক কাজকর্ম, বিল দেওয়া, পেনশন তোলার মতো কাজগুলো করে দিতে ছেলেদের একটা দল গড়ে তোলার কথাও ভাবা হচ্ছে ক্লাব থেকে।

এ পাড়ার অর্থাৎ ত্রিধারার পুজোটাও এখন কলকাতার বিখ্যাত পুজোগুলোর একটা। পুজোর চার দিনে অসংখ্য মানুষ আসেন সারা শহর থেকে। ঢালাও খাওয়াদাওয়া, হইহুল্লোড়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। পাড়ার লোকেদের মেলামেশার সুযোগ করে দিতে পুজো কমিউনিটি থেকে লাঞ্চ-ডিনারের ব্যবস্থা হয়। তাতে অবশ্য বাইরের থেকে আসা মানুষই যোগ দেন বেশি। পাড়ার লোক আসেন না। বেশির ভাগ বাড়ি থেকেই আসে শুধু টিফিন-ক্যারিয়ার। আসলে এই পাড়াটায় কেউ-কাউকে চেনেই না। চেনার ইচ্ছেও নেই। পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে সেটাই দেখে আসছি। এমনকী পাশের বাড়ির লোকেদের মধ্যেও আলাপ-পরিচয় নেই। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো রয়ে যায় এক-একটা বাড়ি।

পঁয়তাল্লিশ বছর আগে যে পাড়াটায় এসেছিলাম, সেখানে ছিল পুরনো আমলের অনেকগুলো বাড়ি। হু হু করে বাড়তে থাকা জনসংখ্যার চাপ সামলাতে এখন সব ভেঙেচুরে আকাশছোঁয়া বহুতল উঠছে একের পর এক। ভৌগোলিক চেহারা তো বটেই, পাড়ার চরিত্রটাও বদলে যাচ্ছে দ্রুত। জমি-বাড়ির দামও যে রকম রকেট গতিতে বাড়ছে! আগামী দিনে বাঙালিদের হয়তো এ পাড়ায় ফ্ল্যাট কেনা সামর্থ্যেও কুলোবে না তেমন! হয়তো দেখা যাবে পাড়ার ৯০ শতাংশই অবাঙালি মানুষের ভিড়। বদলে যাবে এ পাড়ার অভ্যাস, সংস্কৃতিও।

বদলে যাক সব। ক্ষতি নেই। শুধু চাইব, এ পাড়ার দুগার্পুজো ঘিরে বাঙালিয়ানাটুকু যেন অন্তত টিকে থাকে!

লেখক বিশিষ্ট চিকিৎসক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE