Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

তবু অটো চলছে নিজ নিয়মেই

আমজনতার অভিজ্ঞতা বলছে, উল্টোডাঙা থেকে শোভাবাজার এবং উল্টোডাঙা থেকে সল্টলেক, এই রুটে তো যাত্রীরা সাধারণত সিঁটিয়ে থাকেন। দিনের বেলা হাডকো মো়ড় থেকে সল্টলেকের কিছু অটো ছাড়ে।

বেপরোয়া: চালকের ডান দিকে যাত্রী নিয়েই চলছে অটো।

বেপরোয়া: চালকের ডান দিকে যাত্রী নিয়েই চলছে অটো।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:৫৪
Share: Save:

এই ‘দেশে’ তাঁরা সবাই ‘রাজা’! তাই আপন ‘দেশে’ নিজেদের নিয়মেই চলেন কলকাতার অটোচালকেরা। দুর্ব্যবহার, দৌরাত্ম্যের অভিযোগ যতই উঠুক না কেন, রাজপথের ছবিটাও তাই বদলায় না।

যত বার অভিযোগ ওঠে, তত বারই আশ্বাস দেয় প্রশাসন। কিন্তু কাজের কাজ হয় না। ২০১৬ সালে পরিবহণমন্ত্রী হওয়ার পরে শুভেন্দু অধিকারী অটো-নীতি তৈরির কথা বলেছিলেন। ২০১৮ সালে এসেও সেই নীতি তৈরি হয়নি। বলা হয়েছিল, অটোর হেল্পলাইন তৈরি করবে পরিবহণ দফতর। সেটার কী হাল? মুচকি হেসে এক পরিবহণকর্তা বলছেন, ‘‘সোনার পাথরবাটি দেখেছেন কখনও?’’ লালবাজার সূত্রের খবর, অটো নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছিল ট্র্যাফিক বিভাগ। সে সবও ঠান্ডা ঘরে চলে গিয়েছে।

এ সবের মাঝেই মুখ বুজে অটোয় যাতায়াত করেন নিত্যযাত্রীরা। গালাগাল, ধমক সয়ে কিংবা তারস্বরে গান বাজানো উপেক্ষা করেই এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যান নাগরিকেরা। ভাড়াও গুণতে হয় অটোচালকের মর্জি বুঝে। কেমন সেই ঘটনা?

সন্ধ্যার পরে শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের সামনে থেকে উল্টোডাঙা রুটের অটোয় উঠতে গিয়ে এক যুবক জানলেন, অটো মুচিবাজার পর্যন্ত যাবে। কেন? উত্তর না দিয়ে অটোচালকের সটান জবাব, ‘‘উঠলে উঠুন। না হলে সরে যান।’’ পরের একটি অটো যেতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু ভাড়া হেঁকেছিল ২৫ টাকা! আসলে শোভাবাজার থেকে উল্টোডাঙার ভাড়া বড় জোর ১২ টাকা। রাত গড়ালেই ভাড়া বেড়ে যায় শহরের বেশির ভাগ রুটে।

হাফপ্যান্ট পরা চালকের পাশে বসেই অস্বস্তির যাত্রা।

নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ, রাত গড়ালেই টালিগঞ্জ-গড়িয়া রুটের অটো পুরো রাস্তা যায় না। নেতাজিনগর বা রানিকুঠি গিয়ে ফের নতুন অটো ধরতে হয় তাঁদের। গোলপার্ক-গড়িয়া রুটের যাত্রীদেরও একই অভিযোগ। নাগেরবাজার-দমদম স্টেশন রুটের নিত্যযাত্রীরা জানেন, ফি মঙ্গল ও শনিবার অটো পুরো রুটে চলবে না। কারণ, একটি মন্দিরের জন্য যানজট হয়। তা হলে বাস, ট্যাক্সি যাচ্ছে কী ভাবে? অটোচালকদের কাছ থেকে উত্তর মেলে না, মেলে শুধু দুর্ব্যবহার।

ট্র্যাফিক নিয়ম মেনে অটো চলার অর্থ কী, তা হা়ড়ে হাড়ে টের পান ধর্মতলা-পার্ক সার্কাস রুটের যাত্রীরা। তাঁরা বলছেন, ধর্মতলা থেকে চার জন নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও ইলিয়ট রো়ডে ঢুকতেই আরও দু’জন যাত্রীকে তুলে নেওয়া হয়। ওই রাস্তায় অটো রুখতে কোনও পুলিশকর্মী থাকেন না বলেও অভিযোগ। রাত গড়ালেই চৌরঙ্গি থেকে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে অলিগলি দিয়ে চিৎপুরে যাতায়াত করে একাধিক অটো। কিন্তু সেই রুটের কোনও অস্তিত্ব আছে কি না, তা জানা নেই খোদ পুলিশেরও। যেমন নাগেরবাজার থেকে দমদম স্টেশন, পাঁচ জন যাত্রী নিয়ে যাতায়াতই রীতি। বন্দরের বিভিন্ন রুটে আদৌ কলকাতা পুলিশের কোনও নিয়ন্ত্রণ আছে কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

আমজনতার অভিজ্ঞতা বলছে, উল্টোডাঙা থেকে শোভাবাজার এবং উল্টোডাঙা থেকে সল্টলেক, এই রুটে তো যাত্রীরা সাধারণত সিঁটিয়ে থাকেন। দিনের বেলা হাডকো মো়ড় থেকে সল্টলেকের কিছু অটো ছাড়ে। সেগুলির ভাড়া কত, তা জানেন না নিত্যযাত্রীরাও। কোনও অটোচালক ১৫ টাকা নেন, কেউ ২০ টাকা। ভাড়া নিয়ে প্রশ্ন করলেই জোটে দাঁত খিঁচুনি। অনেকেই বলছেন, বইমেলা শুরুর পরে থেকে করুণাময়ী পৌঁছতে ১২ টাকার জায়গায় ২৫ টাকা ভাড়া হাঁকছে উল্টোডাঙার স্ট্যান্ডের অটো।

শহরের বিভিন্ন প্রান্তে এ ভাবেই চলছে অটোরাজ।

মহানগরের রাস্তায় অটো বললে মুম্বইয়ের কথা মনে প়ড়তে বাধ্য। কিন্তু সেখানে অটো চলাচল নিয়ন্ত্রণে থাকে। অটোচালকদের নির্দিষ্ট পোশাক রয়েছে, বুকে ঝোলানো থাকে নম্বরপ্লেট। কিন্তু কলকাতা? রাজপথে অটো ছেয়ে গেলেও কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই এখানে। খাস কলকাতায় মোট কত অটো চলে, তা-ও জানে না পুলিশ কিংবা পরিবহণ দফতর। পোশাক তো দূরের কথা! নিত্যদিন অটোয় যাতায়াত করা এক মহিলা বলছেন, ‘‘এখানে তো বারমুডা কিংবা হাফ প্যান্ট পরে প্রচুর যুবক অটো চালান। তার উপরে অনেকেই অটো চালানোর সময়ে এক পা অন্য পায়ের উপরে দিয়ে বসেন। তাতে বিপদের আশঙ্কা যেমন থাকে, তেমনই সামনের সিটে বসা মহিলার অসুবিধাও হয়।’’ আর এক মহিলা যাত্রী বলছেন, ‘‘রাস্তায় এঁকেবেঁকে অটো চালানো কতটা দ্রুত পৌঁছনোর জন্য আর কতটা হাতল ঘোরানোর ফাঁকে সামনে বসা মহিলার শরীর ছোঁয়ার জন্য, তা আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝি।’’ বুধবার রাতে নেতাজিনগরে এই অসভ্যতার অভিযোগই তুলেছেন এক মহিলা যাত্রী।

পুলিশের একাংশ মেনে নিচ্ছে, অটোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও সামগ্রিক অভিযোগের তুলনায় তা পর্যাপ্ত নয়। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপেই যে অটোর দৌরাত্ম্য ঠেকাতে সমস্যা হচ্ছে, তা-ও জানিয়েছেন তাঁরা। অটো নিয়ে কড়াকড়ি করলে পরিষেবা বন্ধ করে বিপাকে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি এবং অটো ইউনিয়নের নেতা শুভাশিস চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘অটোচালকদের মাথা ঠান্ডা রাখতে বলেছি। কে ঠিক, কে ভুল তার বিচার পুলিশ করুক। তবে অটো পরিষেবা যেন বন্ধ না রাখা হয়।’’

তবে এই শহরে নিয়ম মেনে অটো চালানোর বিরল দৃষ্টান্তও রয়েছে। বাঘা যতীন থেকে রুবি মোড় পর্যন্ত অটো রুটে প্রতি অটোর দূষণ ছাড়পত্র, ফিট সার্টিফিকেট রয়েছে কি না, তা ইউনিয়নকে জানাতে হয়। সে সবের উপরে নজরদারিও চলে। কোনও যাত্রী দুর্ব্যবহারের অভিযোগ করলে সংশ্লিষ্ট অটোর বিরুদ্ধে ইউনিয়নগত ভাবেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু অরাজকতার অটো-চিত্রে যে এটা নেহাতই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, তা মানছেন অটো ইউনিয়নের নেতাদের একাংশও।

ছবি: শৌভিক দে ও সুমন বল্লভ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Auto Auto drivers Traffic Rules
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE