Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে আগুন উস্কে দিল স্টিফেন কোর্টের স্মৃতি

আচমকা আগুন লেগে গেলে পালানোর পথ নেই। বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের প্রধান দু’টি সিঁড়ি, পাশাপাশি। সে দু’টি খোলা। আর রয়েছে চারটি সিঁড়ি।জরুরি ভিত্তিতে যেগুলি ব্যবহার করার কথা।

সুনন্দ ঘোষ
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৬ ২১:৫৯
Share: Save:

আচমকা আগুন লেগে গেলে পালানোর পথ নেই।

বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের প্রধান দু’টি সিঁড়ি, পাশাপাশি। সে দু’টি খোলা। আর রয়েছে চারটি সিঁড়ি। জরুরি ভিত্তিতে যেগুলি ব্যবহার করার কথা। সোমবার বিকেলে সেই জরুরি পথ দিয়ে পালাতে গিয়ে আটক পড়ে গিয়েছিলেন ছাত্রছাত্রী, শিক্ষাকর্মী ও গবেষকদের অনেকেই। কারণ, ওই জরুরি নির্গমন পথগুলির কোনওটিতে আবর্জনার স্তুপ। কোনওটিতে কোলাপসিবল গেটে ঝুলছে বড় তালা। বহুদিন তা খোলাই হয়নি।

মঙ্গলবার সেই বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ৬ বছরের পুরনো স্টিফেন কোর্টের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ভিতরে তখন দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। প্রাণ বাঁচাতে দুদ্দাড় করে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে ছুটে গিয়েছিলেন ১৭ জন ভীত, সন্ত্রস্ত মানুষ। তাঁদের মধ্যেই ছিলেন হাওড়ার সত্যজিৎ সেনগুপ্ত। সিঁড়ির মাথায় গিয়ে দেখেন কোলাপসিবল গেট বন্ধ। তালা মারা। পিছন থেকে সিঁড়ি বেয়ে তখন ছুটে আসছে আগুন। বহু চেষ্টা করে, লাথি মেরে, ঝাঁকিয়েও সেই তালা খুলতে পারেননি সত্যজিৎ ও তাঁর অসহায় সঙ্গীরা। দু’ দিন পরে তাঁদের পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া দেহগুলো ওই সিঁড়ি থেকে উদ্ধার করেন দমকল কর্মীরা।

ঘটনাচক্রে আজ, বুধবার সেই স্টিফেন কোর্টের ঘটনার ৬ বছর পূর্তি হচ্ছে। মোট ৪৩ জন মারা গিয়েছিলেন পার্ক স্ট্রিটের সেই আগুনে। তার পরে ২০১১ সালে শহরের বুকে আমরি হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। মারা যান ৯১ জন। দুটি অগ্নিকাণ্ডের পরে বিভিন্ন ভবনে অগ্নিসুরক্ষার বিধি কড়া ভাবে কার্যকর করার জন্য একের পর এক নির্দেশ জরি করেছিল রাজ্য সরকার। বেশ কয়েকদিন তল্লাশি অভিযানও হয়েছিল শহর জুড়ে। তার পরে সব যে আবার আগের মতোই চলছে তা বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ দেখেই পরিষ্কার। সোমবার আগুনটা আর ঘণ্টা দুয়েক আগে লাগলে কী হত তা ভাবতেই মঙ্গলবার শিউরে উঠছেন আইনজীবীরা।

সোমবারের আগুনে প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সংগ্রহশালাটি পুরো পুড়ে গিয়েছে। নষ্ট হয়ে গিয়েছে শতাধিক বছরের পুরনো প্রাণী সংগ্রহ, লুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীর জিন। জরুরি সিঁড়ি আটকে থাকার প্রসঙ্গ উঠতেই বিভাগীয় প্রধান পার্থিব বসু বললনে, ‘‘ফায়ার অ্যালার্মই নেই এখানে।’’ পাশ থেকে এক অধ্যাপকের মন্তব্য, ‘‘সোমবার আগুনটা আর দু’ঘণ্টা আগে লাগলে কলেজে ৩ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর কী হত, কে জানে!’’ সোমবার যাঁরা ঘটনার সময়ে উপস্থিত ছিলেন তাঁরা জানাচ্ছেন, ‘‘আগুন দু’টি খোলা সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত চলে এসেছিল। দোতলায় তো বটেই, তিন-চার-পাঁচ তলায় হাতে গোনা যে কয়েকজন পড়ুয়া, শিক্ষক, কর্মী, গবেষকেরা ছিলেন, তাঁদের নীচে নেমে আসার পথ তখন বন্ধ। ভয় পেয়ে তাঁরা সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে যান।

অদ্ভুত সেই সমাপতন। স্টিফেন কোর্টের মতোই। সে দিন ছাদের সিঁড়ির কাছে গিয়ে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া সত্যজিতের স্ত্রী সাধনা সেনগুপ্ত-র কথায়, ‘‘এত কিছু পরেও কেন টনক নড়ে না এঁদের? এই সায়েন্স কলেজের আগুনটাও যদি স্টিফেন কোর্টের মতো বড় হতো, কী হতে তখন?’’ এই প্রশ্নের জবাব নেই সায়েন্স কলেজের অধ্যাপকদের কাছে। অ্যালার্ম নেই, স্প্রিঙ্কলার (আগুন লাগলেই সিলিং থেকে যে যন্ত্র চারদিকে জল ছেটাতে শুরু করে) নেই, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র নেই, পালিয়ে যাওয়ার পথ নেই, যেন সাক্ষাৎ যতুগৃহ। বিভাগের অধ্যাপক এনা রায় বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘ভাবতে পারেন, কোনও ফায়ার ড্রিল হয় না এখানে!’’

এই অব্যবস্থায় ক্ষুব্ধ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুগত মারজিত নিজেই। সায়েন্স কলেজের দু’টি সিঁড়ি বাদ দিয়ে বাকি চারটি সিঁড়িকে যে নিয়মিত পুরনো রদ্দি আসবাব ও বাতিল হয়ে যাওয়া যন্ত্র রাখার কাজে ব্যবহার করা হতো সেই সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল। তাঁর কথায়, ‘‘এখানে অদ্ভুত সব নিয়ম। আসবাব বা যন্ত্র বাতিল হলেও তা ফেলা যাবে না। বিক্রি করতে হবে। কবে বিক্রি হবে তার ঠিক নেই। তাই, ফেলে রেখে দাও।’’ আগুন বা আগাম যে কোনও বিপদ সম্পর্কে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, ছাত্রছাত্রী, দারোয়ান সবারই যে সচেতনতার অভাব রয়েছে তাও স্বীকার করে নিয়ে সুগতবাবু বলেন, ‘‘এপ্রিলের মধ্যে সব খোলনলচে বদলে ফেলা হবে। বিদ্যুতের যে লাইন রয়েছে তার অবস্থাও খারাপ। সিইএসসি এবং দমকলের সঙ্গে কথা হয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ballygunge science college fire stefen court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE