তিনি এখন সত্যিই কলকাত্তাওয়ালি।
বছর কয়েক আগেও কালীপুজো নিয়ে আমহার্স্ট স্ট্রিটের অহঙ্কারই ছিল আলাদা। তাতে যে ঘা পড়েছে, তেমনটা এখনও বলা যাচ্ছে না। তবু শহরের কালীপুজোর মানচিত্রে নতুন-নতুন এলাকা ও ক্লাবের উদয়ে উত্সবের আমেজটা এ বার ঢের ঘন হয়ে উঠেছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধে নামতে সেটাই মালুম হল। “কালীপুজোতেও লোকে শহরময় ঘুরে ঘুরে ঠাকুর না-দেখলে আর পুজোটা জমবে কী করে? সব্বাইকে মণ্ডপে টেনে আনতে এ বার এত খেটেছি।” কথাটা বললেন দমদমের পোড়খাওয়া পুজোকর্তা তথা দক্ষিণ দমদম পুরসভায় শাসক দলের অন্যতম মুখ প্রবীর পাল। ‘দমদমের পুজোকে চিনে নিন’ ধুয়ো তুলে ইতিমধ্যেই ৪৫টা কালীপুজো কমিটি মিলে সেখানে সমন্বয় কমিটি গড়ে তুলেছে। লক্ষ্য, বারাসতগামী ভিড়টার একাংশকে কব্জা করা। পাড়ায় ভিড় দেখে প্রবীরবাবুর চোখে-মুখে তৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠল।
রাজারহাট-গোপালপুর প্রাক্তন পুর-চেয়ারম্যান তথা সিপিএমের নেতা তাপস চট্টোপাধ্যায়ও কালীপুজোয় জমি ছাড়তে রাজি নন। থিম, সামাজিক কর্মকাণ্ডের মিশেলে সেখানেও ধুন্ধুমার কাণ্ড। নেতাজি সঙ্ঘের পুজোমণ্ডপে সূর্যদেবের সাত ঘোড়ার রথটা অনেকেরই চোখে পড়ছে।
বেহালায় জেমস লং সরণির পাশে এস এন রায় রোডের পুজোয় আবার অন্য স্ট্র্যাটেজি। মাতৃসেবক সঙ্ঘের কর্তা রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলছিলেন, “বাচ্চাদের টেনে আনা গেলেই পুজো হিট! কান টানতে মাথা আসার মতো বড়রাও ভিড় করবেন।” নানা কিসিমের টেডি বেয়ার দিয়ে মণ্ডপ সাজিয়ে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। পর্ণশ্রীর সূর্য সঙ্ঘে গুজরাতের অক্ষরধাম বা নেতাজি স্পোর্টিংয়ের গ্রামবাংলার আকর্ষণও কম নয়।
কলকাতার কালীপুজোর ছবিটা এই নতুন খেলুড়েরাই বদলে দিয়েছে। কালীপুজোতেও থিম-অস্ত্রের প্রয়োগ বাড়ছে। কালীপুজোর সাবেক পীঠস্থান চেতলার দর্শনার্থীরা অনেকেই দুর্গাপুর ব্রিজের ও পারে রওনা দিচ্ছেন।
সল্টলেকে আগে বিডি ব্লক বা সিএফ ব্লকের মৈত্রী সঙ্ঘের কালীপুজোর নাম-ডাক শোনা যেত। এ বার দেখা যাচ্ছে, সুকান্তনগর, দত্তাবাদ, নয়াপট্টিও কালীময়। দমদমের বন্ধুবান্ধব ক্লাব, খামখেয়ালি সঙ্ঘ, মিত্র সঙ্ঘেরা হাল ছাড়ার পাত্র নয়। লোহার নেটের মণ্ডপ বা ৮০ ফুট লম্বা, ৭০ ফুট চওড়া মণ্ডপ নিয়ে মাতামাতির শেষ নেই। সব পুজোর বাজেট মিলিয়ে টলিউড-বলিউডকে ডেকে এনে জৌলুস অনেকটাই বেড়েছে।
...কী উত্সবের লগনে
কালীপুজোর সন্ধ্যায় নিজের বাড়িতে ফুলঝুরি নিয়ে মেতে উঠলেন
অভিনেত্রী পায়েল সরকার। বৃহস্পতিবার। ছবি: কৌশিক সরকার।
ভারতীয় ক্রিকেট দলে শিখর ধবন, চেতেশ্বর পূজারাদের জৌলুস সহবাগ-গম্ভীরদের অস্তাচলে ঠেলে দিয়েছে। কালীপুজোর ক্ষেত্রে অবশ্য ততটা বলা যাচ্ছে না। সোমেন মিত্রর পুজো আমহার্স্ট স্ট্রিট সর্বজনীন বা সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে নবযুবক সঙ্ঘ (ফাটা কেষ্টর পুজো)-এর চিরকেলে আবেদন ফিকে হয়নি। আমহার্স্ট স্ট্রিট সর্বজনীনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য পাড়ার ডাক্তারবাবু হারাধন সরকারকে এ বার বিশেষ সম্মান জানিয়ে পুরোভাগে রাখা হয়েছে। নবযুবক সঙ্ঘ মুম্বইয়েও পুজো করছে। তারকাদের ডেকে এনে বাইরের গ্ল্যামার আমদানির পথ থেকে খানিকটা সরে এসে এখন আভিজাত্যের ভারেই তারা আলাদা।
চেতলার পুজোতেও আকর্ষণ কোথাও ছিন্নমস্তা (চেতলাহাট) বা হাজার হাত কালী মূর্তি (পিয়ারিমোহন রায় রোড)। দুর্গাপুর ব্রিজের মুখে চামুণ্ডা কালীর জিভ নড়ছে, চোখ জ্বলছে। আবার রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ববি হাকিমের পুজো চেতলা অগ্রণীর দাপটও কম নয়। বারাসতে এ বারও দিনভর পুলিশের সাজ-সাজ রব। বিশেষ যানশাসন দুপুর থেকেই জারি হয়। পায়োনিয়ার অ্যাথলেটিক ক্লাব বা কলোনি মোড়ের নবপল্লি সর্বজনীনের টানে বনগাঁ, বসিরহাট বা কলকাতা একাকার।
এই সব মণ্ডপের পাশাপাশি কালীঘাট বা দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে সকাল-বিকেল ভিড়টাও তো কলকাতার চিরন্তন থিম। এ বার একই সঙ্গে দিওয়ালি ও কালীপুজোয় দিনটার মহিমা যেন দ্বিগুণ।
মাগ্গি-গণ্ডার বাজারে তালি বাজিয়ে পাঁঠাসুখ অবশ্য দুর্লভ। ভোগ-আরতির শেষে খিচুড়ির গন্ধেই রাতজাগাটা তবু সার্থক হয়ে উঠেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy