Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘দাদা’ হলেই সব অনিয়ম মাফ

২০০৯ সালে হাইকোর্ট পুজোর নিয়ম বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু সে নিয়ম কতটা মানা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে গত ন’বছর ধরেই। দক্ষিণ কলকাতার একটি পুজোর কর্তা মেনে নিচ্ছেন, চার পাশে চার ফুট করে রাস্তা ছাড়ার কথা থাকলেও এক দিকে ১২ ফুট ছেড়েই মণ্ডপ করেন তাঁরা।

থোড়াই কেয়ার: নিয়ম ভেঙে তোরণ হয় প্রতি বছরই।

থোড়াই কেয়ার: নিয়ম ভেঙে তোরণ হয় প্রতি বছরই।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৭ ০৭:০০
Share: Save:

দুর্গাপুজো আনন্দের উৎসব। উৎসব ‘নিয়ম ভাঙার’ও! সেই নিয়ম ভাঙছেন রাজ্যের মন্ত্রী, বিধায়ক ও তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গরাও। অন্যদের ক্ষেত্রে যা নিষিদ্ধ, নেতা-মন্ত্রীদের পুজোর ক্ষেত্রে সেটাই ‘বৈধ’। দমকল বা পুলিশ সে সব চোখেও দেখে না। কারণ, যাঁরা নিয়ম মানতে বাধ্য করেন, তাঁদের অকালেই সরে যেতে হয়।

নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘের পুজোটি শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পুজো বলেই পরিচিত। গত বার সেখানে বিজ্ঞাপনের খুঁটি বসাতে গলির দু’পাশে তিন ফুট চওড়া করে গেট তৈরি হচ্ছিল। তাতে ছ’ফুট রাস্তা আটকে যাচ্ছিল। এক পদস্থ পুলিশকর্তা আপত্তি করলেও কাজ হয়নি। এ বছর অবশ্য পুজোর আগেই বদলি হয়ে গিয়েছেন তিনি।

বছর কয়েক আগে পূর্তমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের সুরুচি সঙ্ঘের পুজোয় ভিড় সামলানোর পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি করেন এক পুলিশ অফিসার। কাজ তো হয়ইনি, পুলিশের নিচুতলার অভিযোগ, প্রচণ্ড মানসিক চাপে থাকা ওই অফিসারকে পুজোর সময়টা হাসপাতালেই কাটাতে হয়েছিল!

দমদম পার্ক ভারতচক্রের পুজোয় প্রায় তিন মাস ধরে রাস্তা বন্ধ থাকে বলে স্থানীয়দেরই অভিযোগ। তার ফলে সামান্য দূরত্বও ঘুরপথে যেতে হয়। তিন মাস ধরে রাস্তা বন্ধ থাকায় নাজেহাল হন অনেকেই। এ নিয়ে নানা স্তরে অভিযোগও জানিয়েছেন তাঁরা। লাভ হয়নি। পুলিশেরই একাংশের অভিযোগ, পুজো কমিটির কর্তাদের অনেকেই স্থানীয় বিধায়কের ঘনিষ্ঠ। ওই বিধায়ক কিংবা পুজো কমিটির কর্তারা অবশ্য এ কথা মানেননি।

২০০৯ সালে হাইকোর্ট পুজোর নিয়ম বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু সে নিয়ম কতটা মানা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে গত ন’বছর ধরেই। দক্ষিণ কলকাতার একটি পুজোর কর্তা মেনে নিচ্ছেন, চার পাশে চার ফুট করে রাস্তা ছাড়ার কথা থাকলেও এক দিকে ১২ ফুট ছেড়েই মণ্ডপ করেন তাঁরা। এ নিয়ে দমকলও তেমন আপত্তি করে না। ওই সব পুজোর কর্তাদের দাবি, নিয়ম মেনে জায়গা ছাড়লে পুজোই হবে না।

অনিয়মের পুজো ঘিরে বিশৃঙ্খলাও দেখেছে শহর। দু’বছর আগে দেশপ্রিয় পার্কের ‘সব থেকে বড় দুর্গা’ নিয়ে বিশৃঙ্খলা হয়েছিল। পঞ্চমীর রাতে ওই পুজোয় দর্শক ঢোকা বন্ধ করে লালবাজার বলেছিল, নিয়ম ভেঙে মণ্ডপ হয়েছে। নিয়ম ভেঙে থাকলে তা তৈরি হল কী ভাবে, তার উত্তর পুলিশ দিতে পারেনি।

লালবাজারের নির্দেশ, বড় রাস্তার উপরে ওভারহে়ড গেট করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে ভিড়ে ঠাসা গলিতে কেন গেট হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পুজো উদ্যোক্তাদের একাংশের অভিযোগ, এই নির্দেশ কোথাও লিখিত নেই। ফলে মন্ত্রী-সান্ত্রীদের পুজো কমিটি কিন্তু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ওভারহেড গেট থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ মোটা টাকা আয় করে।

ব্যতিক্রম হচ্ছে না এই বছরেও।

শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, পুজোর জন্য রাস্তা আটকানো হয় না। মণ্ডপও মাঠে হয়। তবে প্রতিমা দেখার জন্য ভিড় হলে তো কিছু করার নেই। পূর্তমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস মন্তব্য করেননি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠদের দাবি, সুরুচি ওভারহে়ড গেট করে না। নিয়মও ভাঙে না। পুজোর সময়ে অতিরিক্ত ভিড় সামাল দিতে পুলিশের পরামর্শ মেনেই কাজ করা হয়। ভারতচক্রের সম্পাদক প্রতীক চৈধুরী বলছেন, ‘‘আমরা নিয়ম ভাঙি না। বিধি মেনেই রাস্তা ছাড়ি। এলাকায় কোনও ক্ষোভ নেই।’’

পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের পুজো বলে পরিচিত একডালিয়া এভারগ্রিনের মণ্ডপের জন্য রাস্তার এক পাশ আটকে যায়। সুব্রতবাবু বলছেন, ‘‘আমরা যে রাস্তা ছাড়ি, তাতে দু’টো অ্যাম্বুল্যান্স ও লরি যেতে পারে। দমকলের গাড়ি যেতেও অসুবিধা হয় না। এ ভাবেই ৭৫ বছর ধরে পুজো হচ্ছে। পুলিশের অনুমতি নিয়েই করা হয়।’’

পুলিশেরও দাবি, প্রভাবশালী হোক বা সাধারণ পুজো, সব ক্ষেত্রেই নিয়ম মেনে অনুমতি দেওয়া হয়। দর্শকদের সুরক্ষাই তাদের প্রধান বিবেচ্য। তবে পুলিশের একাধিক সূত্র মানছে, বহু ক্ষেত্রে গলির পুজোগুলিকে নিরুপায় হয়েই অনুমতি দেওয়া হয়। কাঁটায় কাঁটায় নিয়ম মানলে তারা মণ্ডপই করতে পারবে না। পুলিশের এক প্রবীণ অফিসার বলেন, ‘‘কখনও কখনও প্রভাবশালীদের অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে হয়। কিন্তু সেখানেও যতটা সম্ভব নিয়ম মানার চেষ্টা হয়।’’

নিজস্ব চিত্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE