Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
বেলগাছিয়া-মিল্ক কলোনি

সেই রকগুলো আজ আর নেই

সত্যি বলছি, আমাদের জে কে মিত্র রোডের রকগুলো এক্কেবারে টেনিদার ‘মিত্তিরদের রোয়াক’ বলে মনে হয় আমার! কিন্তু চোখের সামনে দেখলাম, সেই রকগুলো কেমন আস্তে আস্তে বেঁটে হতে হতে রাস্তার সঙ্গে প্রায় মিলিয়ে যাচ্ছে! কী ভাবে? সে কথায় পরে আসব। তার আগে বলি, ছোট থেকে বলতে গেলে রকবাজি করেই বড় হলাম। এলাকার কথা যদি বলেন, তা হলে লোকে আমাদের এলাকাকে চেনে বেলগাছিয়া দত্তবাগান বলে। সেই দত্তবাগানের এই গলির পোশাকি নাম জীবনকৃষ্ণ মিত্র রোড।

দেবশঙ্কর হালদার
শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

সত্যি বলছি, আমাদের জে কে মিত্র রোডের রকগুলো এক্কেবারে টেনিদার ‘মিত্তিরদের রোয়াক’ বলে মনে হয় আমার!
কিন্তু চোখের সামনে দেখলাম, সেই রকগুলো কেমন আস্তে আস্তে বেঁটে হতে হতে রাস্তার সঙ্গে প্রায় মিলিয়ে যাচ্ছে!
কী ভাবে? সে কথায় পরে আসব।
তার আগে বলি, ছোট থেকে বলতে গেলে রকবাজি করেই বড় হলাম। এলাকার কথা যদি বলেন, তা হলে লোকে আমাদের এলাকাকে চেনে বেলগাছিয়া দত্তবাগান বলে। সেই দত্তবাগানের এই গলির পোশাকি নাম জীবনকৃষ্ণ মিত্র রোড। এক্কেবারে উত্তর কলকাতার ছাপ মারা পাড়া আমাদের। গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলোর মতোই তার বাসিন্দাদের মধ্যেও সখ্য তেমনই। গলি-তস্য গলি...এঁকেবেঁকে পাকদণ্ডীর মতো চলে যাওয়া এ গলিতে যখন পা দিই, মনে হয় যেন স্বজনের কাছে এলাম!

আমাদের জে কে মিত্র রোড যেখানে শেষ হয়েছে, তার পরেই শুরু বীরপাড়া লেন। ছোটবেলা থেকেই ওদের পাড়ার সঙ্গে আমাদের ক্রিকেট আর ফুটবল ম্যাচ হয়। ফুটবলটাই বেশি, ক্রিকেটটা কম। যেন দু’টো দেশ! একই মহল্লা, অথচ কী রকম যেন ওদের সঙ্গে মেঠো প্রতিদ্বন্দ্বিতা। চার-দশ বা পাঁচ-এক হাইটের ফুটবল ম্যাচ। সবই অবশ্য রাস্তায়, গ্যালারি হল দু’পাশের বাড়ির রক, বারান্দা আর ছাদ।

ছাদ বলতে মনে পড়ে গেল! আমাদের পাড়ায় এই দৃশ্য হামেশাই দেখা যায়, বিশেষ করে শীতের দুপুরে। এ বাড়ির আচারের বয়াম পাশের বাড়ির ছাদের কার্নিশে বসানো। আসলে দু’টো ছাদ এক্কেবারে লাগানো তো। কিন্তু সেটা খুব বড় কথা নয়। যেটা বলার তা হল, দুপুরে খেতে বসে মাঝেমধ্যেই পাশের বাড়ির কাকিমা-মাসিমার তৈরি আচার ঠাঁই পায় পড়শির থালায়, আলুভাতের অলঙ্কার হয়ে। দত্তবাবুর বাড়ির শুক্তোয় যে বড়ি সঙ্গত করে তা আদপে পাশের সরকারবাবুদের। এটা আমার পাড়ার বিশেষত্ব এবং এটা নিয়ে জাঁক করে বলারও কিছু নেই। কিন্তু, ওই আচার আর বড়ির মধ্যে লেগে থাকা ওমের টান যে বড় কম নয়।

আমাদের পাড়ার চেহারাটা বড় একটা পাল্টায়নি। বাড়িগুলোও মোটামুটি একই চেহারায় দাঁড়িয়ে। ছোটবেলা থেকে বেশ বড়বেলা অবধি এখানে খোলা নর্দমা দেখেছি। বোধহয় বছর পনেরো আগে সেগুলো ঢাকা পড়েছে। টালার ট্যাঙ্কের কাছাকাছি থাকায় আমরা সেই বিরল সৌভাগ্যবানদের অন্যতম যাদের বাড়িতে কোনও দিন জলের অভাব হয়নি। তবে আগে যে চাপে জল পেতাম, এখন আর সেই চাপে পাই না। মনে আছে, জলের চাপ এত বেশি থাকত যে আমাদের বাড়ির দোতলার একটা কলেও টাইম কলের জল উঠত। আমাদের পাড়ার রাস্তায় চারটে কল আছে, গভীর রাতের কিছুটা সময় বাদ দিয়ে সেগুলোয় সারা দিনই জল পড়ে।

নিত্যব্যবহার্য জল নিয়ে আমাদের সে ভাবে সমস্যা হয়নি যতটা হয়েছে জল জমা নিয়ে। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি, আমাদের পাড়ায় জল জমে। গোড়ালি-হাঁটু-কোমর— জল বেড়েই চলে। ছেলেবেলায় বর্ষা আসা তাই বেশ মজার ছিল। কিন্তু যত বড় হলাম, মজাটা আস্তে আস্তে যেন যন্ত্রণায় পরিণত হতে লাগল। কত দিন হয়েছে, শো করতে যাব, কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে বেরোতে পারছি না। কী করি? হাফপ্যান্ট বা বারমুডা আর টি শার্ট পরে প্রায় সাঁতরে রাজা মণীন্দ্র রোডে উঠলাম। ফেরার সময়ে বেশি জলে রিকশাও ঢুকতে চাইত না, বা ঢুকলেও নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত। বাকি রাস্তা ফের সাঁতার। বর্ষায় এটা প্রায় নিত্যকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু গত বছর দু’য়েক ধরে সেই যন্ত্রণা আর ভোগ করতে হচ্ছে না। গত বছর তো জল প্রায় দাঁড়ায়নি। প্রবল বর্ষণে জল জমলেও আমাদের পাড়ার কাছাকাছি পুরসভার যে পাম্প আছে সেটা চালালেই জল খুব দ্রুত নেমে যাচ্ছে। এটা একটা দারুণ অভিজ্ঞতা।

নাগরিক পরিষেবার কথা যদি বলেন, তা বেশ স্বস্তিদায়ক। আমাদের পাড়ায় জঞ্জাল সে ভাবে জমে থাকে না। বড় বড় ভেপার ল্যাম্প যেন উৎসবের আলো ছড়ায়। কিন্তু একটা জিনিসের অভাব বোধ করি। গলির কোণে কোণে বা ফাঁকা কোনও জায়গায় গাছ লাগাতে পারলে বেশ হত। জানি, বড় গাছ লাগানোর জায়গা আমাদের পাড়ায় নেই, তবে ছোট ছোট গাছ লাগানো গেলেও আমাদের চিরচেনা পাড়াটা হয়তো বদলে যেত।

পাড়াটা চিরচেনা...মানুষগুলোও। এই যেমন আমাদের ‘শিশুমহল’ ক্লাবের ভুতোদা। ভাল নাম একটা আছে বটে! প্রণব বসু। কিন্তু সে নামে ডাকলে ভুতোদা নিজেও কি চমকে উঠবেন না? ব্যাডমিন্টনে একদা রাজ্যস্তরের প্লেয়ার, জিমন্যাস্টিক্সেও দুর্ধর্ষ। পাড়ার যে কোনও পুজোয়-অনুষ্ঠানে-বিপদআপদে-খেলাধুলোয়— সব সময় ভুতোদা এগিয়ে। আছেন অজয়দা, এক সময়ে ভাল ফুটবলার ছিলেন। আমাদের হাসিদি, ভুতোদার বোন। বিয়েথা করেননি। যে কোনও পুজোয় উদ্যোক্তার ভূমিকায়। লোকে খেল কি না, পুজোর উপাচারে কোনও খামতি রয়েছে কি না, নজর সব দিকে। শঙ্কর বিশ্বাস, শঙ্করদা, নাটকের হাতেখড়ি ওঁর কাছেই। পাড়ার বৈদ্যনাথ মল্লিককে দেখতাম, বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বাড়ির ছাদে মুগুর ভাঁজছেন, লাঠি চালাচ্ছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন তো।

পাড়ার ‘রোয়াক’গুলো কী ভাবে বেঁটে হল? সে কথায় এ বার আসি। আমাদের শৈশব-কৈশোর-যৌবনের অনেক সোনামাখা সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা কেটেছে ওই সব রকে। এই আজ সকালেও যে রকে এক বন্ধুর সঙ্গে কিছু ক্ষণ বসেছিলাম, সে বাড়ির ছেলেপিলেরা তো গালিগালাজই শিখে গিয়েছিল আমাদের দাক্ষিণ্যে! অনেক আলো-আঁধারি বাস্তবের সামনেও দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল এই রক। রকের পাশের ঝাঁঝরি দেওয়া জানলা...তার ও পারের চরিত্রেরা...নিষিদ্ধ কোনও কিছুর সন্ধান...উত্তেজনা...নিচু স্বরে নিষিদ্ধ আলোচনার হাত ধরে বড়ত্বের চোরাকুঠুরিতে পা রাখা...এই রক জানে আমার প্রথম অনেক কিছু...

রক যেমন ছিল তেমনই আছে। আসলে, যত বার রাস্তা সারাই হয়েছে, বছর বছর পিচ ঢালায় পরতে পরতে রাস্তার উচ্চতা যত বেড়েছে, ততই যেন ছোট হয়ে গিয়েছে আমাদের রকগুলো। আমাদের পাড়ায় একটা ঢালু রক আছে, সেখানে আমরা বেশ হেলান দিয়ে বসতুম। তা হল কি, বাড়ির মালিক সেই রকে বেশ করে স্টোনচিপস লাগিয়ে দিলেন যাতে আমরা আর বসতে না পারি। আরে, আমরা হলাম গিয়ে পটলডাঙার চারমূর্তির জে কে মিত্র সংস্করণ! তা সেই রকের পাথরের উপরেই বসতে শুরু করলাম আমরা, শুরু হল খুঁটে খুঁটে পাথরচাপা রকের পুরনো চেহারা ফেরানোর প্রয়াস। সেই এবড়োখেবড়ো পাথরলাঞ্ছিত রক এখনও দেখা যায়!

যখন ছাদে উঠে দূরের দিকে তাকাই, হাত বাড়াই পুবের পাতিপুকুর, পশ্চিমের পাইকপাড়া, দক্ষিণের বেলগাছিয়া আর উত্তরের দমদমের দিকে— অদ্ভুত এক অনুভূতি ছেয়ে যায় যেন। নীচের দিকে তাকাই...আমাদের বাড়ি, সাতাশের গলি, জে কে মিত্র রোডের চার দিকের বিবর্ণ, ক্ষয়াটে, দীর্ঘ কাল মেরামতি না হওয়া বাড়ির সারি কেমন যেন বন্ধুতা নিয়ে আমার দিকে তাকায়। কত ঋতুচক্রের দিন-রাত, সুখে-বিষাদে, কত দহনকালে এ পাড়ায় যখনই পা ফেলি, ধীর লয়ে যতই এগোই পাকদণ্ডীর মতো গলিপথ ধরে, ততই সে আমায় আঁকড়ে নেয় নিবিড় বন্ধুতায়!

মনে হয়, এ পথে, এ পাড়ায় হেঁটে গিয়েছেন আমার ঠাকুরদা...আমার বাবা...হাঁটছি আমি...আমার ছেলে...যেন বয়ে নিয়ে চলেছি উত্তরাধিকারের মশাল!

ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE