Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

জেলবন্ধুকে ভরসা করে তারই সঙ্গে লকআপে ঠাঁই গোপালের

এক ছাদের তলায়, একই সেলে। আলিপুর জেলের সেই দিনগুলোয় দু’জনের বন্ধুত্বের শুরু। বাইরে বেরিয়েও তাতে ছেদ পড়েনি। এমনকী, মাস দেড়েক আগে লেকটাউনে দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে ‘হাতকাটা’ দিলীপের বিবাহবার্ষিকীর নেমন্তন্নে ভরপেট খানা-পিনাও করে এসেছিল বড়বাজারের ‘ডন’ গোপাল তিওয়ারি।

আদালতের পথে গোপাল তিওয়ারি।  ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

আদালতের পথে গোপাল তিওয়ারি। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৫ ০৩:২৬
Share: Save:

এক ছাদের তলায়, একই সেলে।
আলিপুর জেলের সেই দিনগুলোয় দু’জনের বন্ধুত্বের শুরু। বাইরে বেরিয়েও তাতে ছেদ পড়েনি। এমনকী, মাস দেড়েক আগে লেকটাউনে দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে ‘হাতকাটা’ দিলীপের বিবাহবার্ষিকীর নেমন্তন্নে ভরপেট খানা-পিনাও করে এসেছিল বড়বাজারের ‘ডন’ গোপাল তিওয়ারি।
লালবাজারের খবর: গিরিশ পার্ক-কাণ্ডের তদন্তে নেমে দুই দুষ্কৃতীর এ হেন গলাগলির সংবাদ সামনে আসতেই হাতকাটাকে হাতে পেতে গোয়েন্দারা উঠে-পড়ে লেগেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, তার মারফত গোপালের হদিস লাভ। ঘটনাচক্রে ক’দিন আগে বিধাননগর পুলিশ দিলীপকে গ্রেফতার করে। বুধবার লালবাজার তাকে হেফাজতে নেয়। তার চব্বিশ ঘণ্টা না-কাটতেই জালে পড়ল গোপাল।
গোপালের গতি-বিধির খবর যে হাতকাটার কাছে মিলেছিল, কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা-প্রধান পল্লবকান্তি ঘোযের কথাতেও তার ইঙ্গিত। শুক্রবার তিনি বলেন, ‘‘দিলীপ জানিয়েছিল, গোপাল বড় বড় হোটেলে থাকতে ভালবাসে। তাই বড় মাপের হোটেলগুলোয় আমাদের নজরদারি চলছিল।’’

পুলিশ জানাচ্ছে, গোপালের ঘনিষ্ঠ শাগরেদ দিলীপ সোনকারও কয়েক দিন আগে ধরা পড়েছে, যে কি না ‘গুরু’র হয়ে তোলাবাজির টাকা আদায় করে ভিন রাজ্যে তার কাছে হাওয়ালায় পাঠাচ্ছিল। সে গ্রেফতার হওয়ায় গোপালের টাকার জোগানে টান পড়ে। উপরন্তু তার মুখেই ফাঁস যায় হাতকাটার সঙ্গে গোপালের মাখামাখির কথা। জানা যায়, আলিপুরে ওদের সেলে বন্দি ছিল এক ক্রিকেট-জুয়াড়ি, তার সঙ্গেও গোপাল-দিলীপের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। একে-অন্যকে উকিল দিয়েও সাহায্য করত। একই সঙ্গে গোপালের বন্ধু-বৃত্তে ছিলেন লালবাজারের খাস গুন্ডাদমন শাখার এক অফিসারও!

বস্তুত গিরিশ পার্কের ঘটনার রাতে সেই অফিসারই গোপালের হয়ে পদস্থ অফিসারদের কাছে তদ্বির করতে গিয়েছিলেন বলে লালবাজারের অন্দরের খবর। গোপালকে নাগালে পেতে এত যে কাঠ-খড় পোড়াতে হল, তার জন্যও দুষ্কৃতীর ‘লালবাজার-সোর্স’কে দায়ী করছেন তদন্তকারীদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, গোপালের খোঁজে দেশের নানা জায়গায় হানা দিয়েও পুলিশকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠে, হানাদারির খবর কি পুলিশের ভিতর থেকেই আগাম বেরিয়ে যাচ্ছে?

এ দিনও তার স্পষ্ট কোনও জবাব মেলেনি। গোয়েন্দা-প্রধান শুধু বলেছেন, ‘‘আমাদের গতিবিধির খবর গোপাল পেয়ে যাচ্ছিল। তাই হানা দিয়েও ওকে ধরা যায়নি।’’ ফেরার থাকাকালীন সে একাধিক ফোন ও সিমকার্ড ব্যবহার করত বলেও জানিয়েছেন গোয়েন্দা-প্রধান।

লালবাজারের খবর, ধরা পড়ার ভয়ে গোপাল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করছিল না। উপরন্তু দিলীপ সোনকারের কাছ থেকে টাকা আসা বন্ধ হয়ে যায়, ফলে পকেটে টান পড়ে। এ দিকে গোপালের ছেলেকে দফায় দফায় জেরা করতে থাকে পুলিশ। স্ত্রী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এমন নানা প্রতিকূলতা সৃষ্টি হওয়ায় গোপাল ফিরতে বাধ্য হয়। এক গোয়েন্দা-কর্তার বক্তব্য, ‘‘গোপাল জেরায় বলেছে, সে ছেলেকে এ সবে জড়াতে চায় না। ছেলেকে বারবার জেরা করায় ক্ষোভও প্রকাশ করেছে।’’

গোপালের হদিস করতে গিয়ে গোয়েন্দারা যখন জেরবার, তখনই হাতকাটা দিলীপের কাছে জানা যায়, ২২ মে কলকাতায় ফিরে এসে দমদম-বাগুইআটিতে তারই চেনা-শোনা লোকজনের আশ্রয়ে রয়েছে গোপাল। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি: বৃহস্পতিবার রাতে তেঘরিয়ার যে হোটেলে গোপাল পাকড়াও হয়েছে, সেখানে তাকে হাজির করার নেপথ্যেও ছিল দিলীপের এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি— রাজারহাট-গোপালপুরের এক প্রাক্তন তৃণমূল কাউন্সিলরের ছেলে।

কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, ‘‘ভিন রাজ্যে থাকার সময়েই গোপাল টের পেয়েছিল, রাজনৈতিক প্রতিপত্তির ছাতা মাথায় আর নেই। ভেবেছিল, শাসকদলের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর আশ্রয় হয়তো নিরাপদ হবে। তা-ও হল না!’’

তাই একদা জেলের কুঠুরিতে যাদের বন্ধুত্বের সূত্রপাত, সেই দু’জনেই আপাতত লালবাজারের গোয়েন্দাদের হেফাজতে। ‘‘এখন দেখার, সেন্ট্রাল লক-আপে থাকতে থাকতে ওদের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয় কি না।’’— সহাস্যে বলেন এক অফিসার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE