Advertisement
১৯ মার্চ ২০২৪
সুইসাইড নোটের ছত্রে ছত্রে অবসাদের যন্ত্রণা, একাকিত্বের আশঙ্কা

স্ত্রীর মৃত্যু, নিজের গলা কাটলেন বৃদ্ধ

মৃত দম্পতির ছেলে রাজীব রায় পেশায় অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার। থাকেন গুরুগ্রামে। মেয়ে মৌমিতা রায় ঘটক বিবাহিতা।

রথীন্দ্রনাথ রায় ও মীনাক্ষী রায়। নিজস্ব চিত্র

রথীন্দ্রনাথ রায় ও মীনাক্ষী রায়। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৮ ০৩:৩২
Share: Save:

পাশেই স্ত্রীর মৃতদেহ। সোমবার রাতে তাঁর দিকে তাকিয়েই বসে ছিলেন সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ। চোখ থেকে জল গড়াচ্ছিল অনর্গল। আত্মীয়স্বজন জানতে চেয়েছিলেন, কখন, কী ভাবে মারা গিয়েছেন বৃদ্ধা? উত্তর দেননি বৃদ্ধ। খবর দেননি ডাক্তারকেও। আত্মীয়েরা কিছু ক্ষণের জন্য ঘরের বাইরে গিয়েছিলেন। সেই ফাঁকেই আনাজ কাটার ছুরি এনে নিজের গলায় চালিয়ে দেন বেহালার পর্ণশ্রী থানা এলাকার বেণী মাস্টার লেনের বাসিন্দা রথীন্দ্রনাথ রায় (৭৩)। হাসপাতালে নেওয়া হলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, স্ত্রী মীনাক্ষী রায়ের (৬২) মৃত্যুর শোকেই আত্মঘাতী হয়েছেন রথীন্দ্রনাথ। ধারাবাহিক অসুস্থতা, একাকিত্ব, অবসাদ— জুঝতে না পেরেই অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ আমলা রথীন্দ্রনাথ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বলে অনুমান পুলিশের। তাঁর হাতে লেখা তিনটি চিঠিও পাওয়া গিয়েছে। সেই লেখাগুলির ছত্রে ছত্রে মানসিক অবসাদ আর একাকিত্বের কথাই লেখা। সেখানে স্ত্রীর ধারাবাহিক অসুস্থতা ও সন্তানদের থেকে দূরত্বের কথাও রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ জানান, দীর্ঘদিন ধরেই মীনাক্ষীদেবী অসুস্থ ছিলেন। আড়াই বছর আগে তাঁর মস্তিষ্কে স্ট্রোক হয়। তার পর থেকেই শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। আয়ার পাশাপাশি রথীন্দ্রনাথবাবুই মীনাক্ষীদেবীর সব দায়িত্ব সামলাতেন। মীনাক্ষীদেবী কথাও বলতে পারতেন না। ফিজিওথেরাপি করানো হচ্ছিল তাঁর। কিন্তু তাতে বিশেষ সাড়া মিলছিল না। এর মধ্যে রথীন্দ্রনাথবাবুও অসুস্থ হয়ে পড়েন। বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। আর্থিক ভাবে সচ্ছল ওই পরিবারে মানসিক অবসাদই মূল সমস্যা ছিল বলে জানান আত্মীয়-পরিজনেরা।

আরও পড়ুন: নিকাহ্ হালালা মানব না: নাসিমা

মৃত দম্পতির ছেলে রাজীব রায় পেশায় অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার। থাকেন গুরুগ্রামে। মেয়ে মৌমিতা রায় ঘটক বিবাহিতা। পুলিশ জানায়, সোমবার রাত সাড়ে দশটা নাগাদ রথীন্দ্রনাথবাবু প্রথমে গুরুগ্রামে ছেলেকেফোন করে জানান, মীনাক্ষীদেবী মারা গিয়েছেন। রাজীববাবু অন্য আত্মীয়দের খবর দেন। রথীন্দ্রনাথবাবুদের পাশের বাড়িতেই থাকেন তাঁর ভাই বুদ্ধদেব রায় ও স্ত্রী উমা রায়। খবর পেয়ে উমাদেবী রথীন্দ্রনাথবাবুর বাড়ি গিয়ে দেখেন, স্ত্রীর মৃতদেহ নিয়ে বসে আছেন রথীন্দ্রনাথবাবু। উমাদেবী বলেন, ‘‘আমি অনেক প্রশ্ন করলাম। কিন্তু দাদা কোনও উত্তর দিলেন না। তখন আমি অন্যদের ডাকতে বাইরে যাই।’’ ফিরে এসে উমাদেবীরা দেখেন, বাড়িতে ঢোকার একটি দরজা বন্ধ। ডাকাডাকি শুরু করেন তাঁরা। মোবাইলেও ফোন করেন। অন্য একটি দরজা ভেজানো ছিল। সেটা খুলে ভিতরে ঢুকেই দেখা যায়, বিছানায় স্ত্রীর পাশেই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রথীন্দ্রনাথ। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। পাশেই একটা ছুরি। গলা থেকে রক্ত বেরিয়ে ভেসে যাচ্ছে চর্তুদিক।

কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মৃত দম্পতির মেয়ে মৌমিতা রায়ঘটক। মঙ্গলবার, পর্ণশ্রীতে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

উমাদেবী বলেন, ‘‘আমরা মাত্র ১৫-২০ মিনিটের জন্য গিয়েছিলাম। তার মধ্যেই এত বড় কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললেন দাদা! কী ভাবে এটা করলেন! স্ত্রীকে খুব ভালবাসতেন। তাঁর চলে যাওয়ার শোকটা বোধহয় সামলাতে পারেননি।’’ পাড়ার লোকেরাই পুলিশে খবর দেন। রথীন্দ্রনাথবাবু ও মীনাক্ষীদেবীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে মৃত ঘোষণা করা হয়। তাঁদের মেয়ে মৌমিতাদেবী বলেন, ‘‘মা দীর্ঘদিন ধরেই শয্যাশায়ী ছিলেন। তা নিয়ে বাবা অবসাদে ভুগছিলেন। সকালে এসে ওঁদের দেখে চলে যেতাম। রোজ ফোন করতাম। কয়েক মাস হল, বাবা তেমন কথা বলতেন না। ভাই বাইরে। মা-ও কথা বলতে পারত না। একাকিত্বে ভুগছিলেন বাবা।’’ মৌমিতাদেবীর মেয়ে, দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী শ্রুতি কাঁদতে কাঁদতে মঙ্গলবার বলল, ‘‘দাদু বলেছিল, ভাল থাকিস।’’ বাসিন্দারা জানান, রথীন্দ্রনাথবাবুর কাছে যে কোনও প্রয়োজনে সাহায্য মিলত।

মঙ্গলবার সকালে পুলিশের কর্তারা ওই বাড়িতে গিয়ে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করেন। তাঁদের অনুমান, এটা আত্মহত্যাই। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা-প্রধান প্রবীণ ত্রিপাঠী বলেন, ‘‘স্ত্রীর মারা যাওয়ার পরে রথীন্দ্রনাথবাবু একাকিত্বে ভুগছিলেন বলে মনে হচ্ছে। মৃতদেহের ময়না-তদন্ত করা হচ্ছে। সব দিকই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE