Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

তোলাবাজির ‘স্বর্গে’ ঠুঁটো পুলিশ

হাওড়া স্টেশন ও বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন গোটা এলাকা যে এ ভাবে বেদখল হয়ে গিয়েছে ও ব্যাপক হারে তোলাবাজি চলছে, সে বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না বলে দাবি করেছেন উত্তর হাওড়ার বিধায়ক তথা রাজ্যের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দফতরের প্রতিমন্ত্রী লক্ষ্মীরতন শুক্ল।

বেআইনি গা়ড়ি ও মাছের লরি পার্কিং থেকে নিয়মিত আদায় হচ্ছে তোলা। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

বেআইনি গা়ড়ি ও মাছের লরি পার্কিং থেকে নিয়মিত আদায় হচ্ছে তোলা। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

দেবাশিস দাশ
শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০২:৩৭
Share: Save:

ফেলো কড়ি, খোলো দোকান!

হাওড়া স্টেশন চত্বরে এটাই এখন ব্যবসার মূল মন্ত্র। সাবওয়ে হোক বা বাসস্ট্যান্ড, ইচ্ছেমতো পসরা সাজিয়ে বসে পড়া যাবে যে কোনও জায়গায়। শুধু তোলাবাজদের দাবিমতো গুনে গুনে নজরানাটুকু দিয়ে দিতে হবে। তার পরে মদ-গাঁজা থেকে জামাকাপড়, মাছ-মাংস থেকে মনোহারি জিনিস— শুরু করা যাবে যে কোনও কারবার। কেউ রা কাড়বে না। কিচ্ছুটি বলবে না পুলিশও।

হাওড়া স্টেশন সংলগ্ন দিঘা বাসস্ট্যান্ডের সামনে সরকারি জমিতেই গড়ে উঠেছে দশ ফুট বাই আট ফুটের ছোট্ট একটি ঘর। বাইরের দেওয়ালে গেরুয়া, সাদা, সবুজ রং। আর ঘরের মাথায় পতপত করে উড়ছে ঘাসফুল আঁকা পতাকা। বলে দিতে হয় না, ঘরটি শাসকদল তৃণমূলের। সামনে লেখা ‘হাওড়া সাবওয়ে বাসস্ট্যান্ড হকার সমিতি। সভাপতি: অরূপেশ ভট্টাচার্য, আইএনটিটিইউসি।’

তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র নামে বছর দেড়েক আগে রাতারাতি তৈরি হওয়া ওই ঘরটি নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। অভিযোগ ওঠে, দলের কোনও অনুমতি না নিয়েই তৈরি হওয়া ওই ঘরের দরজা খোলে একমাত্র রাতে। সেখানেই প্রতিদিন চলে হকারদের থেকে আদায় করা ‘চাঁদা’র ভাগবাঁটোয়ারা। সেই সঙ্গে বসে মদ-জুয়ার আসরও। অভিযোগ পেয়ে ওই সময়ে উত্তর হাওড়ার তৃণমূল সভাপতি গৌতম চৌধুরী নিজে এসে তালা ঝুলিয়ে বন্ধ করে দেন ঘরটি। অরূপেশবাবুও নিজের নাম লেখা বোর্ড খুলে নেন।

তোলাচিত্র

(দিনের আদায়)

হকার


ডালা পিছু: ৫০০-৭০০ টাকা


সংখ্যা: গড়ে ১৫০০

ছোট দোকানি


দোকানি পিছু-১৫০ টাকা


সংখ্যা গড়ে- ১২০০

গাড়ি পার্কিং


ছোট গাড়ি- ১০০


বড় গাড়ি-১৫০

সাট্টার ঠেক


সাট্টার ঠেক-২০ থেকে ২২টি


ঠেক পিছু-৫০ হাজার থেকে
১ লক্ষ টাকা

মাছের লরি


লরি পিছু-২০০

মদের ঠেক


মদের ঠেক -১৫টি


ঠেক পিছু -৫০০ টাকা

গাঁজার ঠেক


গাঁজার ঠেক-৩টি


ঠেক পিছু -৫০০ টাকা

কিন্তু ওই চত্বরে বসা হকারদের অভিযোগ, বন্ধ করে দেওয়ার পরে বছর না ঘুরতেই ফের তালা খুলে গিয়েছে ওই ঘরের। পাশাপাশি, গোটা সাবওয়ে ও বাসস্ট্যান্ড চত্বর জুড়ে বেড়ে গিয়েছে জুয়া-সাট্টার ঠেক, চোলাই মদের অবাধ কারবার। বেআইনি ভাবে তোলা হচ্ছে পার্কিং ফি। শুধু তা-ই নয়, সাবওয়ে, সাবওয়ের সিঁড়ি, বাসস্ট্যান্ড চত্বর ও ফুটপাথ ভরে গিয়েছে অসংখ্য দোকান আর হকারদের ডালায়। বছর দেড়েক আগেও যেখানে রাস্তায় পাঁচ-সাতশোর বেশি ডালা ছিল না, এখন সেখানে সংখ্যাটা প্রায় দেড় হাজার। অভিযোগ, এই ডালা পাতার জন্য সরকারি জায়গা হকারদের কাছে মোটা টাকায় ‘বিক্রি’ করে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা পকেটে পুরছে এলাকার কুখ্যাত তোলাবাজেরা।

কিন্তু প্রশ্ন হল, কী ভাবে ফের খুলল ওই ঘরের তালা? আইএনটিটিইউসি-র জেলা সভাপতি অরূপেশবাবু বলেন, ‘‘শুনেছিলাম, হাওড়া পুরসভার ডেপুটি মেয়র মিনতি অধিকারীর সঙ্গে কথা বলে অফিসঘরটি ফের খোলা হয়েছে। কিন্তু আমি আমার নাম লিখতে বারণ করেছিলাম। কেন লেখা হয়েছে, খোঁজ নিয়ে দেখছি।’’

ডেপুটি মেয়র মিনতিদেবীর অবশ্য দাবি, ‘‘ওই অফিসঘর খোলার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। আমি আইএনটিটিইউসি করিও না। অরূপেশ ঠিক বলছেন না।’’ আর উত্তর হাওড়ার তৃণমূল সভাপতি গৌতমবাবু বলেন, ‘‘ওই বেআইনি ঘরটি কারা খুলেছে, জানি না। তবে ওই ঘর নিয়ে নানা অভিযোগ আমার কাছে এসেছে।’’

হাওড়া স্টেশনের সাবওয়েতে ব্যবসা করছেন হকারেরা। অভিযোগ, নিয়মিত তোলার বিনিময়েই মেলে বসার সুযোগ। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

ওই ঘর থেকেই যে গোটা এলাকা ‘নিয়ন্ত্রণ’ করা হচ্ছে, তা মানছেন এলাকার দোকানি ও হকারেরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হকার বলেন, ‘‘হাওড়া সাবওয়ে বা বাসস্ট্যান্ড চত্বরে দোকান বা ডালা নিয়ে বসতে হলে এককালীন ২৫-৩০ হাজার টাকা তো দিতেই হয়। তার উপরে প্রতিদিন দাদাদের ৫০০-৭০০ টাকা করে দিতে হয়।’’

এই ভাবে টাকা নিয়ে হকার বসানোয় হাওড়া স্টেশন সংলগ্ন সাবওয়ে ও বাসস্ট্যান্ডে ফাঁকা জায়গা বলতে আর কিছু নেই। সাবওয়ের এক থেকে এগারো নম্বর গেট পর্যন্ত দু’পাশে কয়েকশো হকার বসে পড়েছেন। তাঁদের বসানো হয়েছে সঙ্কীর্ণ ১১ নম্বর গেটের উপর থেকে নীচের সিঁড়ি পর্যন্ত।

হাওড়া স্টেশন ও বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন গোটা এলাকা যে এ ভাবে বেদখল হয়ে গিয়েছে ও ব্যাপক হারে তোলাবাজি চলছে, সে বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না বলে দাবি করেছেন উত্তর হাওড়ার বিধায়ক তথা রাজ্যের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ দফতরের প্রতিমন্ত্রী লক্ষ্মীরতন শুক্ল। তিনি বলেন, ‘‘আমি শীঘ্রই ওই জায়গা পরিদর্শন করে যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেব। এত কিছু তো জানতামই না।’’

বিধায়ক না জানলেও হাওড়া স্টেশন ও বাসস্ট্যান্ড চত্বরে তোলাবাজি ও নানা অবৈধ কাজকর্ম যে চলছে, তা মানছেন ওই ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর লক্ষ্মী সাহনি। তিনি বলেন, ‘‘এলাকায় মদ-জুয়া-সাট্টার ঠেক এবং তোলাবাজি বেড়ে যাওয়ায় আমি নিজে খুব বিরক্ত। পুলিশকে বলেছি এ সব বন্ধ করতে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE