Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বহুতলের অগ্নিযুদ্ধে অসহায় দমকল, ফের দেখাল চৌরঙ্গি

বড় মাপের ক্ষয়ক্ষতি এ যাত্রা হয়নি। কিন্তু এ শহরে বহুতলের সুরক্ষা নিয়ে ফের বড়সড় প্রশ্ন উঠে গেল মঙ্গলবার। জওহরলাল নেহরু রোডে চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনাল-এর আগুনের ঘটনা এ দিন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বহুতলে আগুন মোকাবিলার কাজে এখনও কতটা অসহায় দমকল। শহরের একাধিক নতুন-পুরনো বহুতলে গত কয়েক বছরে পরপর বিধ্বংসী আগুন লাগার পরেও অগ্নিযুদ্ধের পদ্ধতি এবং সতর্কতা, দুই-ই পড়ে আছে মান্ধাতার আমলে।

এই সরু গলির জন্যই বহুতলের কাছে পৌঁছতে পারল না প্রযুক্তির সাহায্য। অন্তত সাত মিটার চওড়া পথ দরকার ছিল। তাই চার-চারটি স্কাইলিফ্ট মজুত থাকা সত্ত্বেও সেগুলি তেমন ভাবে কাজে লাগানো গেল না। মঙ্গলবার। ছবি: সুমন বল্লভ ও রণজিৎ নন্দী

এই সরু গলির জন্যই বহুতলের কাছে পৌঁছতে পারল না প্রযুক্তির সাহায্য। অন্তত সাত মিটার চওড়া পথ দরকার ছিল। তাই চার-চারটি স্কাইলিফ্ট মজুত থাকা সত্ত্বেও সেগুলি তেমন ভাবে কাজে লাগানো গেল না। মঙ্গলবার। ছবি: সুমন বল্লভ ও রণজিৎ নন্দী

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৩২
Share: Save:

বড় মাপের ক্ষয়ক্ষতি এ যাত্রা হয়নি। কিন্তু এ শহরে বহুতলের সুরক্ষা নিয়ে ফের বড়সড় প্রশ্ন উঠে গেল মঙ্গলবার।

জওহরলাল নেহরু রোডে চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনাল-এর আগুনের ঘটনা এ দিন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বহুতলে আগুন মোকাবিলার কাজে এখনও কতটা অসহায় দমকল। শহরের একাধিক নতুন-পুরনো বহুতলে গত কয়েক বছরে পরপর বিধ্বংসী আগুন লাগার পরেও অগ্নিযুদ্ধের পদ্ধতি এবং সতর্কতা, দুই-ই পড়ে আছে মান্ধাতার আমলে।

একদা পূর্ব ভারতে অন্যতম লম্বা বহুতল বলে পরিচিত, ২২ তলার চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনাল-এর উচ্চতা ৯১ মিটার। শহরে আবাসিক বহুতল এবং বহুতল অফিসবাড়ি, দুই-ই গত কয়েক বছরে হুহু করে বেড়েছে। পুরনো বসতবাড়ি ভেঙে বহুতল গড়ায় উৎসাহ দিতে সম্প্রতি নতুন আইন করেছে পুরসভা। বহুতলে আগুনের কথা ভেবেই এ রাজ্যে কোটি কোটি টাকা খরচ করে ফিনল্যান্ড, জাপানের মতো দেশ থেকে ৬৮ মিটার বা ৫০ মিটারের মই আমদানিও করা হয়েছে। এ দিন কিন্তু সেগুলি কাজে আসেনি। চার-চারটি স্বয়ংক্রিয় মই (হাইড্রলিক ল্যাডার) বা স্কাইলিফ্ট ঘটনাস্থলে গেলেও তারা আগুনের কাছাকাছি পৌঁছতে পারেনি। বাধা হয়ে দাঁড়ায় সরু গলি। যা দেখে বিভিন্ন বহুতলে ছড়িয়েছে আতঙ্কের শিরশিরানি।

দক্ষিণ কলকাতার এক বহুতলে ২২ তলার বাসিন্দা অভিনব কুমার এ দিন যেমন সারাদিন টিভি থেকে চোখ সরাতে পারেননি। ক্যামাক স্ট্রিটে তাঁর অফিসটিও একটি বহুতলে। অফিসে বসে এ দিন তাঁর বারবারই মনে হয়েছে, “চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনালের আগুন আমাদের বাড়িতে বা অফিসে লাগলে কোথা দিয়ে পালাব!”

চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনালের কাছেই একটি বহুতলে ১২ তলায় অফিস সুভাষ দত্তর। সুভাষবাবু এ দিন বলেন, “দমকলের যা অবস্থা দেখলাম, তাতে ভয় ধরে গিয়েছে। এ দিন অফিসের চারপাশে ঘুরে ঘুরে কেবল দেখেছি, দমকল ঢোকার জায়গা আছে কি না।”

নারকেলডাঙার সুতনু দত্ত নিজে বহুতলের বাসিন্দা নন। কিন্তু তাঁর চিন্তা, “পুরসভা যা নিয়ম করেছে তাতে আমাদের এখানে গলি তস্য গলিতে এ বার বহুতল হবে। চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনালেই যখন স্কাইলিফ্ট ঢুকতে পারল না, তখন আমাদের এখানে সরু রাস্তায় কী হবে ভেবে বুক কাঁপছে।” রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন, “আমরা যা-ই করি না কেন, মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে কোনও আপস করব না। যাতে সর্বত্র দমকলের বড় গাড়ি ঢুকতে পারে, দমকল ঠিক মতো কাজ করতে পারে, সেই শর্ত মেনেই বহুতল হবে মহানগরীতে।”

পুরমন্ত্রী আশ্বাস দিলেও পরিকাঠামোর যে সব ফাঁকফোকর এ দিন আরও এক বার প্রকট হয়ে গেল, সেগুলো কী করে মিটবে, সেটাই ভাবাচ্ছে শহরবাসীকে। এ দিন সকাল আটটা কুড়ি মিনিটে চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনালে আগুন লাগার খবর পেয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দমকল পৌঁছে গিয়েছিল ঘটনাস্থলে। বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছিল দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে একটি ঘরে। আর কয়েকটি তলার খোলা জানালা দিয়ে কয়েক জন লাল পতাকা নেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলেন।

চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনাল থেকে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে দমকলের সদর দফতর খুব দূরে নয়। কিন্তু সেখানে জায়গার অভাব থাকায় দমকলের সব থেকে লম্বা ৬৮ মিটারের মইটি সল্টলেকে সেক্টর ফাইভে রাখতে হয়েছে। সুতরাং শহরের যানজট ঠেলে সেটি আসতেই কিছুটা সময় লাগে। এ ছাড়া ৫০ মিটার, ৫৪ মিটার ও ৩০ মিটার উঁচু আরও তিনটি স্কাইলিফ্ট নিয়ে আসা হয়। কিন্তু চার-চারটি স্কাইলিফ্ট গিয়েও তেমন লাভ হয়নি। কেন?

দমকল সূত্রের খবর, বহুতলটির দক্ষিণ দিকে যেখানে আগুন লেগেছে, সেখানে স্কাইলিফ্ট ঢোকার জায়গাই নেই। দমকলের এক কর্তা বলেন, অন্তত সাত মিটার চওড়া ‘ড্রাইভওয়ে’ বা গাড়ি চলার পথ না-থাকলে ওই স্কাইলিফ্ট কাজে লাগানো মুশকিল। ফলে দূর থেকে জল ছুড়তে কিছুটা সাহায্য করা ছাড়া স্কাইলিফ্ট কাজে আসেনি। প্রযুক্তির পথ আটকে দাঁড়িয়েছে পরিস্থিতি। কলকাতা শহরের বাস্তব চাহিদা অনুযায়ী আগুন মোকাবিলার পরিকাঠামোয় যে এখনও অনেক গলদ রয়ে গিয়েছে, প্রকট হয়ে গিয়েছে সেটাই। দমকলকর্মীদের একাংশ এ-ও বলছেন, ৫০ মিটার উঁচু স্কাইলিফ্টটি আমরি-কাণ্ডের সময় থেকেই অকেজো। এ দিন তা হলে কেন সেটা আনা হয়েছিল, স্পষ্ট নয়।

ফলাফল? দমকল কর্তারা এ দিন মেশিন-চালিত মইয়ের মুখ চেয়ে ছিলেন। দূর থেকে মই আনিয়ে দেখা গেল, সেটা কাজে লাগানো সম্ভব নয়। ফলে আগুন নেভানোর প্রকৃত পদক্ষেপ করতেই বেশ কিছুটা সময় বেরিয়ে যায়। তত ক্ষণে আগুন ১৬ তলা ছেড়ে উঠে গিয়েছে ১৭ তলায়। বেগতিক দেখে এক সময় লালবাজারের পুলিশকর্তারা সেনাবাহিনীর দ্বারস্থ হয়েছিলেন। পুলিশের দাবি, ব্যারাকপুর থেকে সেনাবাহিনী কপ্টার পাঠানোর আশ্বাসও দেয়। তবে শেষ পর্যন্ত অবশ্য তার আর দরকার পড়েনি। কিন্তু এ দিন তুলনামূলক ভাবে অল্পে রক্ষা মিললেও কতটা কী হতে পারত, বা ভবিষ্যতে কী হতে পারে, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। দমকলের ডিজি সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলছেন, “যে পরিস্থিতিতে যা করা উচিত, দমকল সেটাই করেছে।”

জাতীয় নির্মাণ বিধি বা ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (এনবিসি) অনুযায়ী ২৪ মিটার বা তার বেশি উঁচু বহুতল হলেই কোনও বিপদে লোকজনকে উদ্ধারের জন্য ১৫ বর্গমিটারের একটি স্বতন্ত্র জায়গা বা রিফিউজ এরিয়া থাকার কথা। কিন্তু ১৯৭৬ সালে তৈরি চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনালে তা নেই। বাড়িটিতে আগুনও এই প্রথম নয়। ১৯৯১-এর ৭ ফেব্রুয়ারি এই বহুতলে আগুন লাগার পরে একটি সরকারি কমিটি তৈরি হয়েছিল। তার অন্যতম সদস্য পুরসভার তৎকালীন চিফ ইঞ্জিনিয়ার মনোজ মজুমদার বলেন, “আমরা বাড়ির পিছনে বিপদের সময়ে বেরনোর সিঁড়ি করতে বলেছিলাম। সেটা হয়নি। এ ছাড়াও অত বড় বাড়ির বিভিন্ন অংশ থেকে আগুন নেভানোর প্ল্যাটফর্ম তৈরির সুপারিশও করেছিলাম। সেটাও হয়নি।” ২০০৮ সালে নন্দরাম মার্কেট বা ২০১০ সালের মার্চে স্টিফেন কোর্টের আগুনের পরেও প্রশাসনিক কমিটির বিশেষ নজরদারির তালিকায় ছিল চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনাল। কিন্তু তবু পরিস্থিতি পাল্টায়নি।

বাড়িটির অফিস কমিটির সম্পাদক মহেশ প্রহালদারের অবশ্য দাবি, স্টিফেন কোর্টের ঘটনার পরে পুলিশ-দমকল-পুরসভার সুপারিশ অনুযায়ী ধোঁয়া বের করার ছ’-সাতটি চিমনি বসানো হয়েছে। এ ছাড়া, ছাদে বেশ কয়েকটি কাচের দরজাও বসেছে। এ দিনও ওই দরজা ভেঙেই বিপন্নরা অনেকে ছাদে ঢুকে পড়েন। বহুতলটিকে অস্থায়ী ছাড়পত্র দিয়েছে দমকল। কিন্তু এ দিনও দেখা গিয়েছে আগুন লাগার সময়কার বিপদঘন্টি বা স্বয়ংক্রিয় স্প্রিঙ্কলারের ব্যবস্থা নেই।

এ যাত্রা সকাল-সকাল আগুন লেগেছিল। বহুতলে তখন বেশি লোক ছিল না। গোড়ায় কিছু ক্ষণ বহুতলটির নিজস্ব জলাধার ও পাম্প কাজে এসেছিল। পরে অবশ্য জল নিয়েও সমস্যা হয়। দমকলের ডিজি বলেন, “জলাধারে আড়াই লক্ষ লিটার জল থাকার কথা। তা হলে খানিক ক্ষণ পর থেকেই জল নিয়ে কেন সমস্যা হল, তা দেখতে হবে।”

দমকল কর্তাদের কারও কারও মত, বহুতলটির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে জেনারেটরের মাধ্যমে পাম্প চালানো যায়নি। তাই বিপত্তি। তার উপরে যথারীতি দমকল কর্মীদের বেশির ভাগেরই ‘ব্রিদিং অ্যাপারেটাস সেট’ বা ‘কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র’ ছিল না। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বয়স্ক কর্মীদের কাজ করতে হয়েছে।

যদিও দমকলমন্ত্রী জাভেদ খানের দাবি, উন্নত সরঞ্জামের মাধ্যমে ধোঁয়া সরিয়ে কাজ করেছে দমকল। কর্মীরা কিন্তু বলছেন, ‘স্মোক এগজস্ট’ ব্যবহার করা হলেও ভুগতে হয়েছে যথেষ্টই। বিষাক্ত ধোঁয়া ঠেলে টপটপ করে ঝরতে থাকা তপ্ত তরলের ফোঁটা গায়ে-মাথায় নিয়েই তাঁদের কাজ করতে হয়েছে।

দমকলের এক কর্তার কথায়, “দমকলের নিচুতলায় ২৬০০ পদই এখন ফাঁকা। কিছু অস্থায়ী কর্মী দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। নির্ভর করতে হচ্ছে বয়স্ক কর্মীদের উপরেই।” তাঁদেরই এক জন বিশ্বরূপ নস্করের হাতে এ দিন কাচ ঢুকে যায়। বেশ কয়েকটি সেলাই পড়েছে। পরে হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে ফের তিনি বহুতলে ঢুকেছেন। আরও এক জন দমকল কর্মীকে শ্বাসকষ্টের জেরে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে শুশ্রূষা করা হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE