আতঙ্ক: ২) সদ্যোজাতকে বুকে আগলে বেরিয়ে এসেছেন মা।
অপারেশন থিয়েটারে তখন শরীরের নীচের অংশ অবশ করার জন্য সদ্য মেরুদণ্ডের নীচে ইঞ্জেকশন দিয়েছেন নার্স। কিছুক্ষণ পরে সিজারিয়ান শুরু হবে। হঠাৎ চারপাশ অন্ধকার। বছর ছাব্বিশের সাবিনা বিবি ভাবলেন, হয়তো ইঞ্জেকশনের জন্যই তাঁর এমন মনে হচ্ছে। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই টের পেলেন, চারপাশের সবাই দৌড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। আশপাশে একটাই চিৎকার: ‘আগুন লেগেছে, বেরিয়ে যাও!’ কিন্তু তিনি উঠবেন কী ভাবে? তাঁর তো নিম্নাঙ্গ অবশ হতে শুরু করেছে। শয্যা থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গেলেন। কোনও মতে নেমেও অপারেশন থিয়েটারের বাইরে বেরিয়ে হাঁটতে পারছিলেন না। সিঁড়ি ঠিক কোন দিকে, সেটাও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল। ততক্ষণে আশপাশের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সিঁড়িতে বসে হাতে ভর দিয়ে নেমে এলেন সাবিনা। দরজার বাইরে তখন উৎকন্ঠায় মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন আনোয়ারা বিবি। ও ভাবে মেয়েকে নামতে দেখে চিৎকার করে সাহায্য চাইতে শুরু করেন মা। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ সাহায্যের জন্য এগিয়ে যায়। আতঙ্কে তখন প্রায় বাক্রুদ্ধ সাবিনা।
আরও পড়ুন: জেল থেকে এল হুমকি-ফোন, আতঙ্ক এলাকায়
শনিবার বেলা পৌনে বারোটা নাগাদ ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পাঁচতলায় স্ত্রীরোগ বিভাগে আগুন লাগে। আগুন সে ভাবে না ছড়ালেও গোটা বাড়ি ধোঁয়ায় ঢেকে যায়। দমকলের চারটি ইঞ্জিনের চেষ্টায় আধ ঘণ্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু ততক্ষণে আতঙ্কে দম বন্ধ করা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে হাসপাতাল জুড়ে। অনেকটা আমরি-কাণ্ডের স্মৃতি থেকেই কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে অনেকে ট্যাক্সি, অটো ডেকে ওয়ার্ড থেকে বাড়ি রওনা হন।
দমকলের এক কর্তা জানান, শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগেছিল। পাঁচতলায় কাঠের কাজ চলছে। আগুনের ফুলকি কাঠে গিয়ে পড়ে। তার পরে সেখান থেকে অন্য বৈদ্যুতিক তারে ছড়ায়। জোরালো শব্দ হতে শুরু করে। তাতেই আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করেন অনেকে।
একা নেমে আসা রোগীকে ট্রলিতে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন হাসপাতালের কর্মীরা।
জয়নগরের সুতপা সন্তান প্রসবের পরে চিকিৎসক সেলাই করছিলেন। হঠাৎ বাইরে চিৎকার। বুঝতে পারলেন, আগুন লেগেছে। তখন প্রাণ বাঁচাতে দৌড়চ্ছেন সবাই। অন্যদের সঙ্গে সুতপাও সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেন। শরীর থেকে তখন রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সবাই আগুনের আতঙ্কে চিৎকার করলেও সুতপা চিৎকার করছেন সন্তান হারানোর আতঙ্কে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ে আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘‘আমার বাচ্চা কোথায়! ওকে আমার কাছে দাও!’’ নীচে নেমে এক পুলিশকর্মীকে দেখে কেঁদে ফেললেন তিনি। এক নার্স তাঁকে আশ্বাস দিলেন, সন্তান নিরাপদে আছে। দ্রুত সুতপাকে তোলা হল ট্রলিতে।
অন্ধকারে চারপাশ ঠাহর করতে পারছিলেন না পায়েল রায়। দিন দুয়েক হল তিনি মা হয়েছেন। আগুন লেগেছে শুনে নিজের সন্তান কোলে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তাঁর পাশের বেডে চোখ পড়ল। দেখলেন, আরও একটি সদ্যোজাত শুয়ে রয়েছে। তার মা পাশে নেই। দু’টি শিশুকে কোলে নিয়েই নেমে এলেন পায়েল। হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষী ও পুলিশকে জানালেন, আর এক শিশুর মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে অবশ্য পুলিশকর্মীরা সেই মাকে খুঁজে করে তাঁর হাতে সন্তানকে তুলে দেন।
এ দিন যেখানে আগুন লেগেছিল তার পাশের ওয়ার্ডে জন্ডিসে আক্রান্ত সদ্যোজাতদের রাখা হয়। ফলে আগুন লেগেছে শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন শিশুর পরিজনেরা। তাঁদের একাংশ অভিযোগ করেন, ধোঁয়ায় রোগীরা নাজেহাল হয়ে যাচ্ছেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারছেন না। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছে ধোঁয়া কমানোর ব্যবস্থা নেই। দমকল আসার আগে প্রাথমিক ভাবে অগ্নিনির্বাপণের কোনও ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। তাঁদের প্রশ্ন, বড় দুর্ঘটনা হলে কী ভাবে সামলাবে হাসপাতাল? তাঁদের অভিযোগ, আতঙ্কিত রোগীদের ওয়ার্ড থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময়ে চিকিৎসক-নার্স বা অন্য কর্মীদের তৎপরতা চোখে পড়েনি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, এ দিন আগুনের আতঙ্কে বহু রোগী নিয়মমাফিক ছুটি না নিয়েই হাসপাতাল থেকে চলে গিয়েছেন। শিশুর হাতে নম্বর বাঁধা দেখে হাসপাতাল চত্বরের সামনের রাস্তা থেকে অনেক মাকে বুঝিয়ে ফের ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সরকারি হাসপাতালের অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ে। এ দিনের ঘটনা ফের সেই প্রশ্নকে জোরালো করল বলে অভিযোগ উঠেছে স্বাস্থ্য দফতরের ভিতরেই। হাসপাতাল সুপার পীতবরণ চক্রবর্তী কোনও অভিযোগই মানতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডে আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে। আগুন নেভানোর জন্য জলের পাইপের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। কিন্তু এ দিনের ঘটনায় সেগুলো ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়নি। খুব ছোট্ট ঘটনা। রোগীরা আতঙ্কিত হয়ে নিজেরাই নেমে পড়েন। কিন্তু হাসপাতালের কর্মীরা পুরোটা সামাল দেন। রোগীদের নিরাপত্তার দিকে কোনও খামতি নেই।’’
ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy