Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

তিন ঝুপড়ির সঙ্গে পুড়ে ছাই স্বপ্নও

পুলিশ জানিয়েছে, সোমবার রাত বারোটা চল্লিশ নাগাদ চিৎপুরের টালা ব্রিজ সংলগ্ন ১৯, প্রাণকৃষ্ণ রোডের বস্তিতে হঠাৎ আগুন লেগে যায়। শীতের রাতে ঘুমে অচেতন ছিল ঝুপড়িবাসী চল্লিশটি পরিবার। তাই ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায়নি, কখন আগুন লেগেছে একটি দরমার ঘরে।

আশাহত: পুড়ে যাওয়া ঝুপড়ির ধ্বংসস্তূপে অক্ষত বইয়ের সন্ধানে মাধবী। মঙ্গলবার, প্রাণকৃষ্ণ রোডে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

আশাহত: পুড়ে যাওয়া ঝুপড়ির ধ্বংসস্তূপে অক্ষত বইয়ের সন্ধানে মাধবী। মঙ্গলবার, প্রাণকৃষ্ণ রোডে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০২:০৮
Share: Save:

আর মাত্র মাস দুয়েক বাকি পরীক্ষার। জীবনের অন্যতম বড় পরীক্ষা, উচ্চমাধ্যমিক। তাই আর পাঁচ জন পরীক্ষার্থীর মতোই জোরকদমে চলছিল প্রস্তুতি। টালির চালের ভাঙা ঝুপড়িতে, শীতের কামড় সয়ে, হ্যারিকেনের মৃদু আলোয়, চেয়েচিন্তে জোগাড় করা বই-খাতা-নোটসের সাহায্যে দাঁতে দাঁত চেপে চালিয়ে যাওয়া লড়াইকে কার্যত পুড়িয়ে ছাই করে দিল হঠাৎ আগুন।

পুলিশ জানিয়েছে, সোমবার রাত বারোটা চল্লিশ নাগাদ চিৎপুরের টালা ব্রিজ সংলগ্ন ১৯, প্রাণকৃষ্ণ রোডের বস্তিতে হঠাৎ আগুন লেগে যায়। শীতের রাতে ঘুমে অচেতন ছিল ঝুপড়িবাসী চল্লিশটি পরিবার। তাই ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায়নি, কখন আগুন লেগেছে একটি দরমার ঘরে। অন্য বস্তির মতোই ঘিঞ্জি ওই এলাকায় একটি বাড়ির সঙ্গে আর একটির তফাত প্রায় নেই বললেই চলে। পুলিশ জানিয়েছে, মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে সংলগ্ন বাড়িগুলিতে। ঘুম ভেঙে যায় গোটা বস্তির। পড়ি কি মরি করে বেরিয়ে আসতে চান সকলে।

স্থানীয় সূত্রের খবর, ওই বাড়িগুলির মধ্যে একটি বাড়ির বাসিন্দা মাধবী প্রামাণিক। তার বাবা গাড়ি চালান। বহু কষ্টে সংসার চালিয়ে মাধবীর পড়াশোনার খরচ জোগান তিনি। বাগবাজারের একটি সরকারি স্কুলের পড়ুয়া মাধবীর এ বছরেই উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার কথা। আগুন থেকে বাঁচতে যখন সবাই ঘর ছাড়ছে উন্মত্তের মতো, তখনও বইগুলো জড়ো করছিলেন মাধবী। চেয়েছিলেন, ওগুলো যদি বার করা যায়, তা হলে অন্তত পরীক্ষাটা দেওয়া যায়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। আগুন এত তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়তে থাকে, যে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় খালি হাতেই বেরিয়ে আসতে হয় মাধবীদের। দমকলে খবর দেওয়ার আগেই, হাতের কাছে যা পাত্র পেয়েছেন তা নিয়ে পাশের খালে ছোটেন সকলে। আগুন যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য খাল থেকে জল তুলে ঢালতে শুরু করেন তাঁরা।

পুলিশ সূত্রের খবর, সকলের প্রাণ বাঁচলেও ওই বস্তির তিনটি বাড়ি কার্যত ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছে। পুড়েছে আর একটি বাড়ির খানিকটা অংশ। সেই সঙ্গেই পুড়েছে মাধবীর আশা, ভরসা। তাঁর বই-খাতাগুলি যে নিছক কাগজের ছিল না, বহু পরিশ্রম, লড়াই আর স্বপ্ন দিয়ে সেগুলি তৈরি ছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ঘরের ভিতরে গ্যাস সিলিন্ডারও ছিল। আগুনের হলকায় সেগুলিও বার করতে পারেননি তাঁরা। মাধবীর বই-খাতা তো অনেক দূরের কথা। কিছু ক্ষণের মধ্যেই দমকল এসে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে।

মঙ্গলবার সকালে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখা যায়, ছাইয়ের স্তূপে পরিণত হয়েছে তিনটি বাড়িই। মাধবী বারবার ছুটে যাচ্ছেন পুড়ে যাওয়া ঘরের ভিতরে। রাশি রাশি ছাইয়ের মধ্যে হাতড়াচ্ছেন বই-খাতাগুলি। বেশির ভাগই পুড়ে গিয়েছে। কোনওটার কয়েকটি মাত্র পাতা গোটা আছে। সেগুলিই উল্টেপাল্টে দেখছেন মাধবী। ‘‘কয়েক মিনিটের আগুন যে এ ভাবে সব পুড়িয়ে দেবে, ভাবতেও পারিনি। আর মাত্র দু’মাস বাকি...’’ স্বর বুজে আসে মাধবীর।

ঘর হয়তো তৈরি হয়ে যাবে। আস্তে আস্তে ফের গড়া হয়ে যাবে পুড়ে যাওয়া সংসারও। কিন্তু এত চেষ্টায় জোগাড় করা বইখাতা, বহু পরিশ্রম করে বানানো নোট কী ভাবে উদ্ধার করে দু’মাসের মাথায় পরীক্ষায় বসবেন, তা ভেবে পাচ্ছেন না মাধবী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Fire Shyambazar Slum
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE