Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
India News

রূপান্তরিত নারীর প্রথম আইনি বিয়ে দেশে, পাত্রী কলকাতার শ্রী

আটপৌরে বাঙালি বিয়ে যেমন ভাবে হয় ঠিক তেমনটাই। বিয়ের আগে কেনাকাটা থেকে শুরু করে আইবুড়ো ভাত। এর পর নান্দীমুখ, জল সইতে যাওয়া, গায়ে হলুদ— সবই হয়েছিল নিময় মেনেই। বিয়ের দিন সন্ধ্যায় ‘যদিদ‌ং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম’ মন্ত্রে ভরে উঠেছিল গোটা বিবাহ বাসর।

যুগলে। শ্রী ঘটক ও সঞ্জয় মুহুরি।

যুগলে। শ্রী ঘটক ও সঞ্জয় মুহুরি।

অমৃত হালদার
শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ১৯:২৫
Share: Save:

আটপৌরে বাঙালি বিয়ে যেমন ভাবে হয় ঠিক তেমনটাই। বিয়ের আগে কেনাকাটা থেকে শুরু করে আইবুড়ো ভাত। এর পর নান্দীমুখ, জল সইতে যাওয়া, গায়ে হলুদ— সবই হয়েছিল নিময় মেনেই। বিয়ের দিন সন্ধ্যায় ‘যদিদ‌ং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম’ মন্ত্রে ভরে উঠেছিল গোটা বিবাহ বাসর। দিনটা ছিল ২০১৬-র ১৭ ফেব্রুয়ারি। ষোলো বছরের বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা হয়ে ওঠা সম্পর্ক সমাজের বাধা-ধরা নিয়মের গণ্ডি পেরিয়ে পরিপূর্ণতা পেয়েছিল সে দিন। মিলেছিল সামাজিক স্বীকৃতি। বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন শ্রী ও সঞ্জয়। গোটাটাই হয়েছিল আর পাঁচটা বিয়ের মতোই। তবুও কোথায় যেন এই বিবাহ অনুষ্ঠানটি ছিল এক্বেবারে স্বতন্ত্র। আসলে শ্রীয়ের বিয়ে বলে কথা।

শ্রী কোনও সেলেব? সেই অর্থে নয়। থিয়েটারে অভিনয় করলেও তাঁর জীবনের লড়াই-ই তাঁকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। তাঁর জীবন কাহিনি যে খুব একটা সহজ নয়। একে ঠিক শ্রীয়ের একার গল্প বলাটাও ভুল হবে। শ্রীকে কেন্দ্র করে এ হল সমাজকে দুই ছাপোষা পরিবারের ঝাঁকানি দেওয়ার বাস্তব গল্প। রূপান্তরিত মহিলা শ্রী ঘটক মুহুরি ও তাঁর স্বামী সঞ্জয় মুহুরি তাঁদের দুই পরিবারের মত নিয়ে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। সেই ঘটনার বয়স হয়ে গেল গোটা একটা বছর। এ বার প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর দিন গোটা দেশে নজিরও সৃষ্টি করলেন শ্রী। তিনিই সম্ভবত প্রথম ভারতীয় রূপান্তরিত মহিলা, যিনি আইনত বিয়েটা সেরে ফেললেন।

আইনি ভাবে বিবাহ বন্ধনে বাঁধা পড়লেন শ্রী ও সঞ্জয়।

আর পাঁচটা বিয়ে তো আইন মেনে হয়, তবে তাঁদের বিয়েটায় কেন সরকারি সিলমোহর লাগবে না? এক দিন সঞ্জয়কে এই মনের কথাটা বলেও ফেলেছিলেন শ্রী। এটা যে সঞ্জয়েরও ইচ্ছে ছিল। অবশেষে বাগুইআটির একটি হোটেলে গত শনিবার বিয়ের রেজিস্ট্রেশন সেরে ফেললেন এই দম্পতি। সামাজিক বিয়ের এক বছর বাদে আইনি বিয়ের পথটা ততটা মসৃণ ছিল না। গোটা পরিবার মেনে নিলেও আইনি পথে বিয়ে নিয়ে সমস্যাটা ছিলই। একটা পুত্রশিশুর শরীর নিয়ে জন্মালেও বড় হয়ে ওঠা মনটা তো ছিল নারীরই। এরপর ধীরে ধীরে ‘পুরুষালি’ শরীরটায় একটু একটু করে ‘নারীত্ব’ গড়ে তোলা। এখন তো শ্রী পুরোপুরি ‘শ্রীমতী’। কিন্তু সমস্ত নথিতেই তাঁর পরিচয় ছিল পুরুষ হিসেবে। অতএব সব নথি থেকেও ‘পুরুষালি’ চিহ্ন মুছে ফেলার প্র্রক্রিয়া শুরু হল। কারণ আইনত নারী না হলে এ দেশে পুরুষের সঙ্গে আইনি বিয়ে অসম্ভব। সামাজিক বিয়ের পর এই সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ হতে একটা বছর সময় লাগল। অবশেষে মধুরেণ সমাপয়েৎ।

অনুষ্ঠানে সব সময় বৌমার পাশে পাশে দেখা গেল শ্রী-র শ্বশুর সমীর মুহুরিকে। রেজিস্ট্রেশনের সময় তিনিই প্রথম সাক্ষী হিসেবে সই-সাবুদ সেরে শোনালেন তাঁদের বাড়িতে বৌমা আসার পর আনন্দের জোয়ার বয়ে যাওয়ার কাহিনি—‘‘এই তো মাসকয়েক আগে আমি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। তখন তো বৌমাই হাসপাতাল-বাড়ি করে আমায় সারিয়ে তুলল। আর ওঁর হাতের খাসির মাংস তো অসাধারণ। একটা দিন বাড়িতে না থাকলে গোটা বাড়িটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। হ্যাঁ শুরুতে কিন্তু কিন্তু ভাব ছিল ঠিকই। তবে আমার বড় ছেলের ওঁর প্রতি ভালবাসা আমাকে অনেকটাই সহজ করে তুলেছিল।’’

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল গোটা পরিবার।

কথাটা শুনেই কিছুটা লাজুক শ্রী-এর স্বামী সঞ্জয়। গলায় দুরন্ত দৃঢ়তা নিয়ে বললেন, ‘‘বিষয়টা সবার পক্ষে হজম করা কঠিন। আমার বউ কিছু দিন আগেও শরীরে ছেলে ছিল। কিন্তু সমস্ত বাধা কাটিয়ে উঠে আজ আমরা আইনত স্বামী-স্ত্রী। বছরখানেক আগে আমাদের বিয়ের খবর যখন খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিল, তখন তা নিয়ে কম চর্চা হয়নি। পাড়া থেকে অফিস সর্বত্রই আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে ওঁদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। এই তো দেখুন না আজকের অনুষ্ঠানে সবাই কত আনন্দ করেছে। সবাই মেনে নিয়েছে।’’ সঞ্জয় যেমন শ্রী-এর হাতটা শক্ত করে ধরে রয়েছেন, তেমনই সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ রূপান্তরিত বা রূপান্তর আকাঙ্খীদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিন- এটাই শুধু তাঁর চাহিদা। সঞ্জয়ের চোখে তাঁর স্ত্রী শুধুমাত্র ভালবাসাই নয়, আদর্শও বটে। শ্রী-এর হাতে হাত রেখেই জানালেন- ‘‘শ্রীয়ের জীবন ওঁর মতো আরও অনেকে জানুক। তাঁরাও নিজের শর্তে বেঁচে থাকার সাহস পাক।’’

আরও পড়ুন: টুসি-ছন্দার কাহিনি, এভারেস্টের হাতছানি টলিউডের ছবিতেও

সল্টলেট বৈশাখীর সরকারি আবাসনে বেড়ে উঠেছেন শ্রী। বাড়ির বড় ‘ছেলে’। ‘পুরুষবেলা’র নাম ছিল অন্য। বাবা সরকারি চাকুরে। সে সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ার এত রমরমা ছিল না। ইন্টারনেটও ছিল সীমিত আয়ত্তের মধ্যে। তাঁর নিজের ‘জানা’-র জগতের ব্যাপ্তিও ছিল কম। রূপান্তরকামীদের অস্তিত্ব, আন্দোলন, জীবন সম্পর্কে অজ্ঞই ছিলেন শ্রী নিজেও। আবাসনে মেয়েরাই ছিল তাঁর বন্ধু। নিজেকে অস্বাভাবিক না-ঠেকলেও চারপাশের মানুষের চোখে সেটাই ধরা পড়ত। তখন ক্লাস ফোর-ফাইভ। সিঁড়ির নীচের ঘুপচি-তে আবাসনের কিছু বড় ছেলে আচমকা জাপটে ধরত। চুমু খেত। তাঁর মেয়েলি স্বভাব আর হাবভাব নিয়ে সমস্যা শুরু হল বাড়িতে-স্কুলেও। হাসি, মসকরা, আলোচনা, মন্তব্য, ঠেস, বকুনি— ক্রমশ নিজের ভিতরেই একটা বদ্ধ কুঠুরিতে আটকে যাচ্ছিল শ্রীয়ের সত্তা। কিন্তু তাঁর মা পূর্ণিমা ঘটক আর সঞ্জয়ের হাত ধরে এখন শ্রী সম্পূর্ণ নারী।

মা পূর্ণিমা ঘটকের সঙ্গে দম্পতি।

শ্রী-য়ের কথায়, তাঁর মা এবং সঞ্জয়—এই দু’জন না থাকলে কবে, কোথায় ভেসে যেতেন জানা নেই। ক্লাস এইটে কেষ্টপুরের একটি অনামী স্কুলে ভর্তি হয়ে দেখা হয় সঞ্জয়ের সঙ্গে। কিন্তু সে সময় কোনও প্রেমটেম ছিল না। ক্রমশ অনেকগুলো বছর পাশাপাশি চলতে চলতে কখন যেন বন্ধুত্ব, মায়া-মমতা-সহানুভূতি-প্রেম সব একাকার হয়ে গেল। শারীরিক ভাবে মেয়েতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলেন শ্রী। পুরো খরচটাই জোগালেন সঞ্জয়। অসম্ভব কঠিন একটা প্রক্রিয়া। যেমন শরীরে যন্ত্রণা হয়, তেমনই মানসিক ভাবে ছিন্নভিন্ন হতে হয়। বাড়ির লোকেদের সহানুভূতি এই সময় ভীষণভাবে দরকার পড়ে। একটি বিরাট প্রক্রিয়া। ‘‘কিন্তু এই প্রক্রিয়ার জন্য আমার বেশি দিন সময় লাগেনি। কেননা রূপান্তরের প্রাথমিক ধাপ হল মানসিক ভাবে শক্ত হয়ে ওঠা। যেহেতু আমি আত্মপ্রত্যয়ী ছিলাম তাই সময়টা কম লেগেছিল। তবে যখন হরমোন প্রক্রিয়া শুরু হল। সে সময়টা আমার জীবনের সব চাইতে কঠিন সময় ছিল। এই সময়টায় মেয়েদের পোশাক পরে বাইরে বেরোনো শুরু করতে হয়। তখন ভয়ানক টিটকিরি, বিদ্রুপের মুখে পড়তাম। এক দিন বিধানগর স্টেশনে ট্রেন ধরবো বলে দাঁড়িয়ে। এক দল ছেলে বিভিন্ন ধরনের অঙ্গভঙ্গি করতে লাগল আমায় দেখে। তখনও আমার শরীর পুরোপুরি ‘মেয়ে’ হয়ে ওঠেনি। তাই আমায় নিয়ে বহুক্ষণ ধরে চলল হাসাহাসি। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি থেকে বাইরে বের হতে ভয় হত। মা তখন আমায় সাহস জোগাতো। বলত আমায় ফোন করবি, আমি গিয়ে নিয়ে আসবো।’’

অপারেশনের পরে সবচেয়ে বড় টেনশন ছিল হবু শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে নিয়ে। সঞ্জয় বললেন, ‘‘আমি বাড়ির বড় ছেলে। আমার ক্লাসের বন্ধু হিসেবে শ্রীকেও আমার বাড়িতে সবাই ছোটবেলা থেকে দেখেছেন প্যান্ট-শার্ট পরা একটা ছেলে হিসাবে। হঠাৎ করে আপনার বাড়ির ছেলে যদি বলে যে, সে তার এক পুরুষ বন্ধুকে সামাজিক ভাবে বৌ করে আনতে চায় তা হলে আপনি কি প্রথমে সহজভাবে নেবেন? বরং আমি অনেক ভাগ্যবান যে, আমার বাড়িতে শেষ পর্যন্ত সবাই শ্রী-কে বুকে টেনে নিয়েছেন।’’

কেউ অনুপ্রেরণা কেউ বা সহযোদ্ধা।

শ্রীয়ের এখন ভরা সংসার। মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত স্বামী। শ্বশুর, শাশুড়ি, দেওর নিয়ে জমজমাট সুখী পরিবার। আছে একটি ছোট্ট পোষ্য ব্রাউনিও। বন্ধুদের একটাই আক্ষেপ, যদি ওঁদের একটা সন্তান হতো তা হলে ওঁরা পরিপূর্ণতা পেত আর কোনও আক্ষেপই থাকত না। কিন্তু বিজ্ঞান এখনও সেই পথ দেখিয়ে উঠতে পারেনি। তাতে খুব একটা আক্ষেপ নেই শ্রী এবং সঞ্জয়ের। সন্তান দত্তক নেওয়ার পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছেন তাঁরা। এরই সঙ্গে চালু করেছেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, নাম ‘ত্রয়ী ফাউন্ডেশন’। এই সংস্থা শ্রী-এর মতো মানুষদের নিয়ে কাজ করে। তাঁদের অসময়ে পাশে দাঁড়ানো থেকে শুরু করে মানসিক ভাবে সাপোর্ট দেওয়া হয়। এখানেই শেষ নয়, পথশিশুদের পড়াশোনায় সাহায্যের পাশাপাশি মূক ও বধির, প্রতিবন্ধী মানুষজনের পাশে দাঁড়ানোই ত্রয়ী ফাউন্ডেশনের কাজ। শ্রী-এর কথায় এই সংস্থাই এখন আমার সন্তান। এই সংস্থাকে বড় করে তোলাটাই এখন আমার লক্ষ্য। আর এই কাজে তিনি পাশে পেয়েছেন তাঁর স্বামী সঞ্জয়, তিস্তা দাস, বিমান পাল, মোনালিসা বোস, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং গৌতম চট্টোপাধ্যায়কে।

প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে কেক কাটছেন শ্রী ও সঞ্জয়, দেখুন ভিডিও

আরও পড়ুন: রক্তফুলের বরণডালা

শ্রীয়ের আক্ষেপ শুধু একটাই— ‘‘সবাই বলছে আমি বড় কাজ করেছি। সবাই সাধুবাদ দিচ্ছেন। কই সরকার তো আমায় কোনও স্বীকৃতি দিচ্ছে না। আমার মতো মানুষজন সমাজে এখনও ব্রাত্য। ‘এলজিবিটি কমিউনিটি’র মানুষজনের হয়ে কাজ করার জন্য কোনও সাহায্য তো করছে না সরকার। আমায় ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রান্সজেন্ডার ওয়েলফেয়ার বোর্ড-এর সদস্য করা হচ্ছে না তো। এই সদস্য পদ পেলে আমি আরও অনেক বেশি কাজ করতে পারতাম আমার মতো মানুষজনদের জন্য।’’

কলকাতার এক প্রান্তে গতভাঙা-বলিষ্ঠ পদক্ষেপে শ্রীময় হয়ে উঠছে একটা সংসার। আর তাঁদের মতো আরও আরও এমন অনেক সংসার ভবিষ্যতে রঙিন হয়ে উঠবে বলেই আশা শ্রী এবং সঞ্জয়ের। আরও আশা, সমাজ এই স্বাভাবিকটা স্বাভাবিক হিসেবেই দেখবে, দেখতে জানবে, দেখতে শিখবে এক দিন।

ছবি: তপেন্দ্র নাথ কুণ্ডু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE