অসহায়: এর নামও শৌচাগার। বন্দর এলাকায়। —নিজস্ব চিত্র।
নতুন ফ্ল্যাট কিনতে গিয়ে তাতে অন্তত দু’টি শৌচাগার না-পেলে মধ্যবিত্ত ক্রেতার নাকও কুঁচকে ওঠে। কারণ, বাসযোগ্যতার নিরিখে তাকে ন্যূনতম সুবিধা বলেই ধরা হয়। অথচ, এই কলকাতার মধ্যেই আছে আর একটি কলকাতা, যেখানে রয়েছে দৃষ্টিকটু বৈপরীত্য। সেখানেও মানুষেরই বসবাস। কিন্তু ১২০০-১৩০০ জন পিছু সাকুল্যে একটি বা দু’টি শৌচাগার বরাদ্দ! সেই শৌচাগার পূতিগন্ধময়, অস্বাস্থ্যকর। তবু কেউ তাতে নাক সিঁটকানোর বিলাসিতা দেখাতে পারেন না। কারণ একটাই। তাঁরা দুঃস্থ। নাগরিক পরিষেবা থেকে বঞ্চিত থাকতেই অভ্যস্ত।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘স্বচ্ছ ভারত’ প্রকল্পই হোক কিংবা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নির্মল বাংলা’— অভিযোগ, গোটা দেশেই শহুরে বস্তি এলাকায় সব চেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে শৌচাগারের আকাল। কলকাতাও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রকল্প রয়েছে, অর্থেরও অভাব নেই। তার পরেও শহরাঞ্চলে এমন অনেক বস্তি আছে, যেখানে একটি পাড়ার প্রতিটি লোকের জন্য হিসেবমতো শৌচাগারে এক মিনিট সময়ও বরাদ্দ হয় না। অধিকাংশ বস্তিতেই মানুষ অনুপাতে কমিউনিটি টয়লেটের সংখ্যা অত্যন্ত কম। বাড়ি লাগোয়া শৌচাগারের তো প্রশ্নই নেই। অতএব, খোলা জায়গায় শৌচকর্মই ভরসা। ফলে, রোগের সংক্রমণ থেকে শুরু করে মেয়েদের শ্লীলতাহানি, সব কিছুই অবাধে চলতে থাকে। এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে কলকাতা বন্দর এলাকার বস্তিগুলি। কারণ, সেখানে বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কলকাতা পুরসভার জমি নিয়ে দীর্ঘদিনের বিবাদ। অনুমোদন পাওয়ার ঝামেলায় পাকা শৌচাগার আর গড়ে ওঠে না। বস্তিবাসীর ভাগ্যে জোটে খোলা নর্দমার উপরে তৈরি দরজাবিহীন বাঁশের মাচা।
এমনই একটি বস্তিতে যাওয়া হয়েছিল গত সপ্তাহে। বন্দর এলাকায় পুরসভার ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের রামনগর আলগাড়া মজদুর লেনে। প্রায় ১৮০টি ঘরে ১২০০ মানুষ থাকেন। প্রত্যেকেই শ্রমিক বা মুটের কাজ করেন। মহিলা আর শিশুরা (শিশুশ্রম-বিরোধী আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে) ঘুড়ির কাঠি তৈরিতে নিযুক্ত। ২০১৫ সাল পর্যন্ত তাঁদের জন্য কোনও শৌচাগার ছিল না। খোলা জায়গাই ছিল মলমূত্র ত্যাগের ঠিকানা। পুরসভা ২০১৬ সালে সেখানে দু’টি শৌচাগার তৈরি করে। অর্থাৎ, ১২০০ লোকের জন্য দু’টি শৌচাগার। তার মধ্যে একটির দরজা ঝড়ে ভেঙে পড়ে রয়েছে। ব্যবহার করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ, রইল বাকি একটি। তাতে ক’জন আর যেতে পারেন? বেশির ভাগ বাসিন্দাই ফের বাঁশের মাচার দ্বারস্থ। বস্তিতে গিয়ে কথা বলার সময়েই ঘিরে ধরে নিজেদের অসহায়তা, যন্ত্রণার কথা উগরে দিল চোদ্দো-ষোলো-বাইশ বছরের কিশোরী-তরুণীরা।
এলাকার মেয়েরা হাত ধরে নিয়ে গিয়ে দেখাল, খেলার মাঠের ধারে নর্দমার উপরে তৈরি বাঁশের মাচার ভয়াবহ শৌচাগার। নর্দমা ছাপিয়ে মল উপচে পড়ছে। তার সঙ্গে মিশেছে কাদা আর আবর্জনা। দুর্গন্ধে টেকা দায়। মাছি, পোকা থিকথিক করছে। ওই জায়গায় বসে মলমূত্র ত্যাগ করায় বারবার মূত্রনালীর সংক্রমণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে মেয়েরা। ঋতুকালীন সময়, গর্ভবতী অবস্থায় বা অসুস্থ হলে তাঁদের কী শোচনীয় দশা হয়, সহজেই অনুমেয়।
দরজাহীন শৌচাগার। চার দিক ঢাকা যে ত্রিপলে, তা শতচ্ছিন্ন। এক কিশোরীর কথায়, ‘‘শৌচাগারে থাকাকালীন অনেক সময়ে খেলার মাঠ থেকে ছেলেরা এসে ত্রিপলের ফুটোয় চোখ রাখে। অনেকে ফাঁক দিয়ে হাত ধরে টেনে বার করতে চায়, ছবি তোলে, গায়ে হাত দেয়। আর পারছি না। আমাদের বাঁচান।’’ হেনস্থা থেকে বাঁচতে একেবারে ভোরে বা গভীর রাতে তাদের অনেকে শৌচাগারে যেতে চায়। কিন্তু সেখানেও এসে যায় নিরাপত্তার প্রশ্ন। এলাকার কাউন্সিলর ইকবাল খান (মুন্না) অবশ্য ঝাঁঝের সঙ্গে দাবি করেন, ‘‘আমাকে বদনাম করতে কিছু লোক একদম মিথ্যে কথা বলছে। ওখানে অনেক শৌচাগার রয়েছে!’’ পুরসভার বস্তি উন্নয়ন বিভাগের মেয়র পারিষদ স্বপন সমাদ্দারের কথায়, ‘‘অর্থের অভাব নেই। কিন্তু স্থানীয় কাউন্সিলরদের তো এসে জানাতে হবে, কোথায় কত টয়লেট দরকার।’’
বন্দর এলাকার বস্তিগুলির এই সমস্যার কথা কি রাজনৈতিক নেতাদের কানে পৌঁছয় না?
এলাকার বিধায়ক তথা রাজ্যের নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের বক্তব্য, ‘‘ওই জায়গাগুলিতে একটিও শৌচাগার ছিল না। আমি ২০১১ সালের পরে ৩০০ শৌচাগার বানিয়েছি। বন্দর কর্তৃপক্ষকে অনেক বার বলেছি, কিছু জমি আমাদের দিতে। সেখানে বস্তিবাসীদের জন্য কোয়ার্টার্স তৈরি করে দেব। তাতে যথেষ্ট শৌচাগার থাকবে। ওরা দিচ্ছে না। তবে মানুষ আমার কাছে এসে সমস্যার কথা জানালে আমরা নিশ্চয়ই কমিউনিটি শৌচাগার বানিয়ে দেব।’’ কিন্তু এলাকার কিশোরী-তরুণীদের প্রশ্ন, বিধায়ক পর্যন্ত তারা পৌঁছবে কী করে? কে তাদের যেতে দেবে? বন্দরের মুখপাত্র সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় গোটা বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
কলকাতা পুরসভার বস্তি উন্নয়ন বিভাগের ডিজি সৌমিত্র ভট্টাচার্যের কথাতেও উঠে এসেছে বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জমি নিয়ে সমস্যা। ‘‘বস্তি এলাকায় মানুষ অনুপাতে শৌচাগার কোথাও বেশি, কোথাও কম। জমির সমস্যা যেমন আছে, তেমন রয়েছে নির্বিচারে ড্রেন আর পাইপলাইনের উপরে বাড়ি তৈরি করে ফেলার সমস্যা।’’ তবে লোকসংখ্যার অনুপাতে বস্তিতে কমিউনিটি টয়লেট তৈরি নিয়ে পুরসভা যে তেমন মাথা ঘামায়নি, তা একাধিক পুরকর্তা স্বীকার করেছেন।
২০১২-’১৩ সালে কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, হায়দরাবাদের বস্তিতে শৌচাগারের উপরে ‘স্কোয়াটিং রাইট’ নামে একটি সমীক্ষা চালায়। তাতে দেখা যায়, ৩৫-৪০ শতাংশ বস্তিবাসী মহিলা শৌচাগারে শ্লীলতাহানির সম্মুখীন হয়েছেন। দিল্লিতে বস্তির ৭০ শতাংশ মহিলা শৌচাগার ব্যবহারের সময়ে অপমানজনক কথা ও যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। কলকাতায় তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও সমীক্ষা হয়নি। কিন্তু এখানেও ভয়ে, অপমানে কুঁকড়ে থাকা মেয়েরা সাহায্য চাইছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy