Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
গোপালচন্দ্র লেন-কবিরাজ রো

সম্প্রীতি আর সাবেক ঐতিহ্য টিকে রয়েছে আজও

গতিময় রাজপথটাকে পিছনে ফেলে কখনও প্রশস্ত কখনও সঙ্কীর্ণ রাস্তাটা এঁকেবেঁকে এগিয়ে দু’দিকে চলে গিয়েছে। তারই দু’ধারে অসংখ্য সাবেক বাড়ি। কোনওটার গায়ে পড়েছে নতুন রঙের প্রলেপ, কোনওটা বা কালের স্রোতে ধূসর, মলিন।

পশুপতি রায়

পশুপতি রায়

শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৬ ০১:৪৪
Share: Save:

গতিময় রাজপথটাকে পিছনে ফেলে কখনও প্রশস্ত কখনও সঙ্কীর্ণ রাস্তাটা এঁকেবেঁকে এগিয়ে দু’দিকে চলে গিয়েছে। তারই দু’ধারে অসংখ্য সাবেক বাড়ি। কোনওটার গায়ে পড়েছে নতুন রঙের প্রলেপ, কোনওটা বা কালের স্রোতে ধূসর, মলিন। অলস দুপুরে ফেরিওয়ালার ডাকে সদর দরজা ফাঁক করে আগ্রহী ক্রেতার পুরোদস্তুর দরদাম কিংবা টানা রিকশা আর পথচারীর ভাড়া নিয়ে ক্ষণিক বচসা। বিকেল হতেই ক্রিকেটে মগ্ন কচিকাঁচাদের উল্লাস, সন্ধ্যায় আজানের সুর আর কাঁসর-ঘণ্টার আওয়াজ। এই মিশ্র সংস্কৃতি ধরে রেখেছে কলুটোলা অঞ্চলে আমাদের পাড়া কবিরাজ-রো, গোপালচন্দ্র লেনের সুখ দুঃখের দিন যাপন।

পাড়ার এক প্রান্তে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ অন্য প্রান্তে রবীন্দ্র সরণি। স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের উল্টো দিকে শুরু হওয়া কবিরাজ রো গিয়ে মিশেছে ফিয়ার্স লেনে। তার ধার ঘেঁষে রয়েছে গোপালচন্দ্র লেন, দেবেন্দ্র মল্লিক লেন। কাছেই সাগর দত্ত লেন, হরিণবাড়ি লেন আর বলাই দত্ত স্ট্রিট। পাড়ায় আনাচে কানাচে আজও মিশে আছে সাবেক বনেদিয়ানার ছাপ।

এক কালের বনেদি বাঙালি পাড়াটায় আজ অবাঙালিদের সংখ্যাই বেশি। পুরনো বাসিন্দারা অনেকেই পাড়া ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। এখানকার বেশির ভাগ বাসিন্দা মুসলমান। গর্ব করে বলি এটা সম্প্রীতির পাড়া। রয়েছে পাড়াপড়শির সঙ্গে সুসম্পর্ক, বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ানোর অভ্যাস। কিংবা উৎসবে-পরবে একে অপরকে মিষ্টি পাঠানোর ঐতিহ্যটা আজও অটুট।

এ পাড়ায় সাত পুরুষ ধরে আমাদের বসবাস। ছেলেবেলার পাড়াটা ছিল অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আজকের পাড়াটা যেন পরিবহণ পাড়া হয়ে গিয়েছে। তখন এ পাড়ায় থাকতেন কবিরাজ সত্যব্রত সেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন কাউন্সিলর। প্রতি দিন ভোর পাঁচটায় উঠে পোষা চিতাবাঘের বাচ্চা নিয়ে এলাকা পরিদর্শনে বেরোতেন। ঠিক এখন যেমন অনেকেই পোষা সারমেয়টিকে নিয়ে প্রাতর্ভ্রমণে বেরোন। তাঁর নামেই কবিরাজ রো। তখনও এ অঞ্চলে থাকতেন বেশ কিছু অভিজাত মুসলমান পরিবারও।

পুরনো পাড়া-পড়শিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও কমেছে যোগাযোগ। এখনও উৎসব অনুষ্ঠানে তাঁদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়। ভাল লাগে এখনও পাড়ায় বেরোলে বহু পরিচিত মুখ এগিয়ে এসে কুশল বিনিময় করেন। তবে নতুনরা কেমন যেন এড়িয়ে চলেন।

অন্য পাড়ার মতো এখানেও উন্নয়ন চোখে পড়ে। এলাকার কাউন্সিলর রেহানা খাতুন এলাকার মানুষের সঙ্গে ভালই যোগাযোগ রেখে চলেন। বসেছে জোরালো আলো। নিয়ম করে রাস্তা পরিষ্কার আর জঞ্জাল সাফাই হয়। তবে কিছু মানুষের নাগরিক সচেতনতা না থাকায় যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে আবর্জনা ভর্তি প্লাস্টিক। পথচলতি কিছু মানুষ যেখানে সেখানে পানের পিক ফেলায় দেওয়ালগুলো নোংরা হয়ে থাকে। সময়ের সঙ্গে বেড়েছে জনসংখ্যা। তবে সেই তুলনায় পানীয় জলের জোগান কিন্তু বাড়েনি। আগে মল্লিকঘাট পাম্পিং স্টেশন থেকে যে গঙ্গার জল আসত পাতাল রেল তৈরির সময় তা বিচ্ছিন্ন হয়। তখন থেকে জলের সমস্যা বেড়েছে, বিশেষত গরমে। বর্ষায় এখনও জল জমার সমস্যা ভোগায়। তবে আগের তুলনায় সেটা অনেকটাই কমেছে। মশার সমস্যা এবং কুকুরের উপদ্রবও রয়েছে।

এক দিকে ঠেলাগাড়ি, ভ্যানের যাতায়াত। অন্য দিকে, গাড়ির পার্কিং-এর জন্য যাতায়াতে সমস্যা হয়। বিশেষ করে রাতের দিকে পাড়ায় ঢুকতে বেরোতে সমস্যা নিত্যদিনের ব্যাপার। তেমনই উৎসবের দিনগুলিতে গাড়ি ও মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সমস্যা বেড়ে যায়।

অতীতে এ পাড়া ছিল বাবু কালচারের প্রাণকেন্দ্র। কিছু বনেদিবাড়িতে ঘুড়ি ওড়ানোর চল ছিল। ভোরবেলা সাগর দত্তের বাড়ির সামনে পালোয়ানদের সঙ্গে কুস্তি করত বাড়ির ছেলেরা। আমাদের বাড়িতে বরাবরই রয়েছে পাখি পোষার শখ। কবিরাজ সত্যব্রত সেনের বাড়িতে জন্তু জানোয়ার পোষার রেওয়াজ ছিল। সেকালের বাবুদের পায়রা ওড়ানোর শখও ছিল। সেরাজু, লক্কা, উমর, গলাফুলো কত রকমের পায়রা! দত্তবাড়ির নন্দলাল দত্তের ছিল বুলবুলির লড়াইয়ের শখ। মোরগের লড়াইও হত। সে সবই স্মৃতি।

এ পাড়ার পুজোপার্বণ নিজ ঐতিহ্যে উজ্জ্বল। কাছেই সাগর দত্ত লেনে আর দেবেন্দ্র মল্লিক লেনে হয় সর্বজনীন দুর্গোৎসব। আর আমাদের প্রাচীন পারিবারিক পুজোটিকে কেন্দ্র করেও পাড়া-পড়শির উৎসাহের কমতি নেই। পুজোর আগে থেকেই ক্যামেরা হাতে ভিড় করেন উৎসুক মানুষ। কাছাকাছির মধ্যে মতি শীলের বাড়ি এবং ধর বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। আগে দুর্গাপুজোয় বসত ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর।

রকের আড্ডার পরিবেশ এ পাড়ায় কোনও দিন ছিল না। তবে আড্ডা অবশ্যই ছিল। সেটা বসত বাড়ির বৈঠকখানায়। আসতেন বন্ধু স্থানীয় পাড়া-পড়শিরা। অনেকে ঠাকুরদালানের সিঁড়িতে বসেও আড্ডা দিতেন।

অনেক কিছু হারালেও টিকে আছে এ পাড়ার খেলাধুলোর চল। সাগর দত্ত লেনের মুখে কিছু মানুষ ক্যারাম খেলেন। বাড়ির সামনেই ছোটরা নিয়মিত ক্রিকেট খেলে। এটা দেখতে ভাল লাগে। তবে কাছাকাছি মাঠ না থাকায় পাড়ার রাস্তাই ভরসা। ১৫ অগস্ট ফুটবল টুর্নামেন্ট বা ২৬ জানুয়ারি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আজও আকর্ষণীয়। কাছেই পাইনবাড়ি, সেনবাড়ির ছেলেরা উঠোনে এসে এক কালে ব্যাডমিন্টন খেলত।

এখানে এখনও প্রভাব পড়েনি ফ্ল্যাট কালচারের। আজও বাড়ির সংখ্যাই বেশি। এক কালে কবিরাজ রো-এ থাকতেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী গণেশ পাইন, কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ-এর প্রতিষ্ঠাতা নন্দলাল রায় প্রমুখ।

কাছাকাছির মধ্যে রয়েছে টেরিটি বাজার, বৌবাজার, আর কলেজ স্ট্রিট বাজার। পাড়ার ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য কাছাকাছির মধ্যে সব কিছুই রয়েছে। প্রয়োজনে হেঁটেও দিব্যি পৌঁছনো যায়। তেমনই দিনের যে কোনও সময়ে পাওয়া যায় যানবাহন।

এমন একটা পাড়া ছাড়ার কথা কখনও দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারি না। তার উপর সাতপুরুষের শিকড়ের টান, পাঁচ খিলানের ওই ঠাকুরদালান, পুরনো বাড়িগুলো একটা মায়াবলে মুগ্ধ করে রেখেছে। মনের সুখ তো এখানেই আছে।

লেখক প্রাক্তন ব্যবসায়ী

ছবি: প্রদীপ আদক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE