বিলম্বিত: সেবাসদনে সন্তান-সহ বিরথিদেবী। —নিজস্ব চিত্র।
হাসপাতালের ট্রলি বেশি মূল্যবান নাকি প্রসূতি আর তাঁর গর্ভস্থ সন্তানের জীবন?
খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী এলাকার মধ্যে অবস্থিত নামী সরকারি প্রসূতি হাসপাতাল। উন্নত পরিষেবার পরিকাঠামো মজুত সেখানে। সেই হাসপাতালের ঠিক উল্টো দিকে কার্যত কয়েক মিনিটের দূরত্বে বিজলি সিনেমা হলের সামনের ফুটপাথে শুয়ে প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছেন এক মহিলা। তাঁকে ঘিরে কিছু কৌতূহলী, কিছু উদ্বিগ্ন মুখের উঁকিঝুঁকি।
গত ১১ নভেম্বর সকালের ঘটনা। পুলিশ মারফত চিত্তরঞ্জন সেবাসদন হাসপাতালে খবর পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু সময় মতো কোনও হাসপাতাল কর্মী বা চিকিৎসক এসে সেই আসন্নপ্রসবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাননি। খাস কলকাতার রাজপথের ধারে ফুটপাথে কয়েক জন ফুটপাথবাসী, দোকানদার ও পুলিশ কর্মীরাই চাদর-কাপড় জোগাড় করে কোনও মতে আড়াল তৈরি করেছিলেন। সেখানেই শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন ওই মহিলা। পরে অবশ্য হাসপাতাল কর্তাদের কানে বিষয়টি যাওয়ায় ওই মহিলা ও তাঁর সন্তানকে তড়িঘড়ি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেই সময় ডিউটিতে থাকা চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্মীরা যুক্তি দিয়েছেন, হাসপাতালের ট্রলি হাসপাতাল চত্বর থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত তাঁরা সময় মতো
নিতে পারেননি। তাতেই এই বিপত্তি। ‘অপরাধ’ যে যথেষ্ট গুরুতর তা বুঝেই আসরে নেমে পড়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এখন কোনও ভাবে যাতে মা ও শিশুর যত্নের ত্রুটি না হয় সে জন্য তাঁরা মরিয়া। হাসপাতালের এক প্রবীণ ডাক্তার যাকে বলছেন ‘পাপস্খালন!’ কিন্তু তাঁদের স্বস্তি দিচ্ছে না আরও একটি বিষয়। পুলিশ ও স্থানীয় ফুটপাথবাসীদের অনেকেই জানিয়েছেন, ঘটনার সময় ওই মহিলার সঙ্গে বছর আট-নয়ের এক বালক ছিল। সে ওই মহিলাকে মা বলে ডাকছিল। এই ডামাডোলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ওই মহিলা নিজে যে কোনও হদিস দেবেন তারও উপায় নেই। কারণ, তিনি মানসিক ভাবে স্থিতিশীল নন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম কথা বলছেন। কোনও মতে নিজের নাম বলতে পেরেছেন বিরথি দেবী। বাড়ি বিহারের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। তাঁর কোনও আত্মীয় বন্ধুকেও এর মধ্যে দেখা যায়নি। আরও কিছু দিন তাদের হাসপাতালে রেখে তার পর কোনও হোমে পাঠানোর কথা ভাবছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, প্রসূতি হাসপাতালের উল্টো দিকের ফুটপাথে আসন্নপ্রসবা যখন ছটফট করছেন তখন হাসপাতাল কর্মীরা কী করে ট্রলির নিরাপত্তাকে বেশি গুরুত্ব দিলেন? আর যদি কোনও চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর মনে সেই দ্বিধা এসেও থাকে তা হলে তাকে কী ভাবে দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক সমর্থন করলেন? হাসপাতালের সুপার আশিস মুখোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ‘‘বোঝাপড়ার অভাবে গোটা ব্যাপারটা ঘটেছে। গ্রুপ-ডি কর্মীর মনে হয়েছিল, ট্রলি হাসপাতালের বাইরে গেলে হয়তো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বকাবকি করবেন। দায়িত্বে থাকা আরএমও-কেও তিনি সেটা বলেন। সেই চিকিৎসক বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তার উপর অনেক সকালে ঘটনাটি ঘটেছিল বলে আমাদের ফোন করতেও তাঁরা দ্বিধাবোধ করেছেন।’’
সুপারের আরও বক্তব্য, ‘‘এই সব কারণে সিদ্ধান্ত নিতে দেরির জন্যই ফুটপাথে প্রসব হয়ে যায়। তবে তার পরেই মা ও শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। আমি প্রথমে দু’জনকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু তদন্ত করে দেখি গোটা বিষয়টাই অনিচ্ছাকৃত। তাই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়।’’ রাজ্যের মা ও শিশু স্বাস্থ্যের নজরদারিতে গঠিত টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘পুরোটা শুনে মনে হচ্ছে অনিচ্ছাকৃত একটা ভুল। জুনিয়র ডাক্তার আর হাসপাতাল কর্মীরা সিদ্ধান্ত নিতে একটু দেরি করে ফেলেছিলেন।’’ তবে ওই মহিলার অন্য সন্তানকে নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও চিন্তিত। তাঁরা জানিয়েছেন, এক বার আট-নয় বছরের সেই বালককে বিরথি দেবীর কাছে হাসপাতালে দেখা গিয়েছিল। তার পর থেকে সে বেপাত্তা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy