Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

পুরুষ না মহিলা? এই সংশয়েই হাসপাতালে জায়গা নেই রূপান্তরকামীর

যদিও রানি একা নন, বাংলাদেশ থেকে আসা গিয়াসউদ্দিন আহমেদ পিজিতে লিঙ্গ পরিবর্তন করে মহিলা হন। পরে তাঁর ত্বকের সমস্যা হয়। ফের পিজি-র প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে গেলে তাঁকে মহিলা ওয়ার্ডে ভর্তি হতে বলেন ডাক্তারেরা।

রানি মজুমদার।

রানি মজুমদার।

দীক্ষা ভুঁইয়া ও তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৭ ০২:১১
Share: Save:

যন্ত্রণায় ছটফট করছেন রোগী। গলব্লাডারে পাথর। দ্রুত অস্ত্রোপচার দরকার। কিন্তু পুরুষ না মহিলা, হাসপাতালের কোন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হবে তাঁকে, সেই ধন্দে কেটে যায় দিনের পর দিন। কারণ রোগী রূপান্তরকামী।

ঘটনাটি কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালের। এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অনেক সময়েই কোনও না কোনও হাসপাতালে গিয়ে বঞ্চিত হন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা, রূপান্তরকামীরাও। যাঁরা ইতিমধ্যেই রূপান্তরিত, তাঁরাও। কেন? সমস্যা হল, চিকিৎসাক্ষেত্রে তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। সরকারি পরিকাঠামোয় পিজিতে লিঙ্গ পরিবর্তনের অস্ত্রোপচার হয় ঠিকই, কিন্তু কোনও আইনি সমস্যার মোকাবিলায় নেই ‘মেডিকো-লিগাল সেল’। ফলে তৈরি হচ্ছে নানা জটিলতা। সমস্যা মেনে নিয়েছেন চিকিৎসকেরাও। কিন্তু এর সমাধান কী, দিশা দেখাতে পারেননি তাঁরা। ইতিমধ্যেই রোগীদের লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে স্বাস্থ্য ভবনে।

ধরা যাক রানিগঞ্জের বাসিন্দা, রূপান্তরকামী রানি মজুমদারের কথা। ছেলেদের স্কুলে পড়েছেন। নাম ছিল কল্যাণ। সকলে তাঁকে ছেলে বলেই জানতেন। কিন্তু সপ্তম শ্রেণিতে এক বন্ধুর প্রেমে পড়ে শুরু হয় লুকিয়ে থাকা মেয়ের সত্তা চেহারায় ফুটিয়ে তোলার মানসিক টানাপড়েন। ২০১৪-এ স্তন প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার করান রানি। ২০১৫-এ এক চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন সুন্দর মুখ ও হাসি পাওয়ার জন্য। কিন্তু অভিযোগ, অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে সৃজন মুখোপাধ্যায় নামে ওই চিকিৎসক তাঁর স্বাভাবিক সৌন্দর্য নষ্ট করে দেন। রানির মুখ এক জন বৃদ্ধার মতো হয়ে যায়। ঝুলে যায় চিবুকের চামড়া। এখন ওড়নায় মুখ লুকিয়েই ঘোরেন তিনি।

আরও পড়ুন: অতি বর্ষণে সেতু ভেঙে ওডিশায় বিপর্যস্ত ট্রেন

কিন্তু হাল ছাড়েননি ৪০ ছুঁইছুঁই রানি। যদি কোনও ভাবে মুখ ঠিক করা যায়, দাঁতগুলো ঠিক হয়— চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছেন স্বাস্থ্য দফতর, ওয়েস্ট বেঙ্গল ডেন্টাল কাউন্সিল ও ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে। অভিযোগ, কোথাও তাঁর বক্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ডেন্টাল কাউন্সিল জানিয়েছে, গাফিলতির প্রমাণ মেলেনি। চিকিৎসক সৃজন মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘এক বা দু’টি অস্ত্রোপচারেই সব সময়ে চাহিদা মতো মুখের আদল আসে না। পরে ছোটখাটো আরও অস্ত্রোপচার দরকার হয়।’’ সেটা কি তিনি রানিকে জানিয়েছিলেন? সৃজনবাবুর জবাব, ‘‘এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছয় যে আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব ছিল না। একটা অস্ত্রোপচারের পরে রোগী এত অভিযোগ নিয়ে বিভিন্ন মহলে গেলে পরবর্তী অস্ত্রোপচার কী ভাবে হবে?’’ রানির অবশ্য দাবি, শুরুটাই হয়েছে বড়সড় ভুল দিয়ে। তিনি ভরসা রাখবেন কী ভাবে? আত্মীয়স্বজন বর্জিত রানির টাকা-পয়সা যা ছিল, প্রায় শেষ। আর চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়। তবু সুন্দর হাসির জন্য এখনও ‘মিরাকল’ ঘটার আশায় তিনি।

যদিও রানি একা নন, বাংলাদেশ থেকে আসা গিয়াসউদ্দিন আহমেদ পিজিতে লিঙ্গ পরিবর্তন করে মহিলা হন। পরে তাঁর ত্বকের সমস্যা হয়। ফের পিজি-র প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে গেলে তাঁকে মহিলা ওয়ার্ডে ভর্তি হতে বলেন ডাক্তারেরা। কিন্তু তখনও কাগজ-কলমে তাঁর নাম পরিবর্তন হয়নি। তাই ভর্তির সময়ে মহিলা ওয়ার্ডে গিয়াসউদ্দিনের নাম ‘এন্ট্রি’ই করা যায়নি।

সমস্যাটা মেনে নিয়েছে স্বাস্থ্য ভবনও। এর সমাধান কী? স্বাস্থ্য দফতরের প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এ রাজ্যে রূপান্তরকামীদের কথা ভেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম ট্রান্সজেন্ডার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড তৈরি করেন। তিনি এ বিষয়ে সচেতন। যা করার নিশ্চয় করবেন।’’

কিন্তু কবে? তার উত্তর কোনও স্বাস্থ্যকর্তার কাছেই পাওয়া যায়নি। একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জানিয়েছে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে রূপান্তরকামীদের জন্য মেডিকো-লিগ্যাল বোর্ড না থাকায় নানা জটিলতা তৈরি হচ্ছে। স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হলে কোথায় যাবেন, কী করবেন কোনও দিশা নেই। একাধিক সরকারি হাসপাতালের কর্তা ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্য ভবনে আবেদন জানিয়েছেন, লিঙ্গ পরিবর্তনের অস্ত্রোপচার যে সব হাসপাতালে হয় সেখানে মেডিকো-লিগ্যাল বোর্ড তৈরি করা হোক। ওই বোর্ডে আইনজীবী এবং সমাজবিদেরাও থাকবেন। কিন্তু সেই আবেদনের কোনও উত্তর মেলেনি। স্বাস্থ্য সচিব রাজেন্দ্র শুক্লও এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

রাজ্য ট্রান্সজেন্ডার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডও এ বিষয়ে এখনও সরব নয়। বোর্ডের চেয়ারপার্সন মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘হাসপাতালের ফর্মে নারী-পুরুষের সঙ্গে ‘অন্যান্য’ কথাটিও থাকা দরকার। রূপান্তরকামীদের জন্য মেডিকো-লিগ্যাল সেল থাকাও জরুরি। আইনি অধিকার থাকলে লড়াইয়ে কিছুটা এগিয়ে থাকা যায়। সে দিকটা সরকার দেখবে আশা রাখি। তবে পরিচয়ের বিভিন্ন সূক্ষ্ম স্তর থাকে। সাধারণ মানুষও যদি সেটা অনুভব না করেন, তা হলে পরিস্থিতি বদলাবে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Transgender Patient Hospital Negligence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE