Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

রড দিয়ে খুঁচিয়ে খুন বধূকে, গ্রেফতার ৩

সদর দরজায় পাহারা দিচ্ছে শাশুড়ি। দোতলায় সিঁড়ির মুখে বৌদিকে মাটিতে ফেলে রড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে ছোট দেওর। আর ভাইকে এই কাজ করতে সাহস জোগাচ্ছে মেজো দেওর ও তার স্ত্রী। পুলিশের কাছে অভিযোগে এমনটাই জানিয়েছিলেন স্থানীয়েরা। সরশুনা বাদামতলার মণ্ডল পরিবারে সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে বিবাদ প্রায় দশ বছরের। তার জেরে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে হাতাহাতি তাই নতুন কিছু নয় প্রতিবেশীদের কাছেও।

হত্যাকাণ্ডের পরে সেই ঘর।

হত্যাকাণ্ডের পরে সেই ঘর।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:৪৫
Share: Save:

সদর দরজায় পাহারা দিচ্ছে শাশুড়ি। দোতলায় সিঁড়ির মুখে বৌদিকে মাটিতে ফেলে রড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে ছোট দেওর। আর ভাইকে এই কাজ করতে সাহস জোগাচ্ছে মেজো দেওর ও তার স্ত্রী। পুলিশের কাছে অভিযোগে এমনটাই জানিয়েছিলেন স্থানীয়েরা।

সরশুনা বাদামতলার মণ্ডল পরিবারে সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে বিবাদ প্রায় দশ বছরের। তার জেরে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে হাতাহাতি তাই নতুন কিছু নয় প্রতিবেশীদের কাছেও। কিন্তু সেই পারিবারিক বিবাদই যে এমন নৃশংস রূপ নেবে, তা শনিবার রাত সাড়ে ন’টা পর্যন্ত ভাবতেই পারেননি তাঁরা। অভিযোগ, ওই পরিবারের বড় বউকে রড দিয়ে খুঁচিয়ে খুন করা হয়। অভিযুক্তেরা সবাই ওই মহিলার আত্মীয়স্বজন বলে পুলিশ জানিয়েছে। তাদের মধ্যে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। খোঁজ চলছে আর এক অভিযুক্তের।

শনিবার রাতে ঘটনাটি ঘটেছে ৫৬ নম্বর সরশুনা মেন রোডে। পুলিশ জানিয়েছে, মৃত ওই মহিলার নাম রীতা মণ্ডল (৩৫)। খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে তার মেজো দেওর টিঙ্কু মণ্ডল, টিঙ্কুর স্ত্রী পুষ্পা ও শাশুড়ি মীরা মণ্ডল। মূল অভিযুক্ত, ছোট দেওর সঞ্জীব ফেরার। অভিযোগ, সঞ্জীবই রড দিয়ে রীতাদেবীর মাথায়, পিঠে আঘাত করে। তার পরে সেই রড দিয়েই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাঁকে খুন করে।

পুলিশ সূত্রের খবর, ওই রাতে স্থানীয় এক ব্যক্তি পুলিশকে ফোনে জানান, এক মহিলা খুন হয়েছেন। সরশুনার ওই বাড়ি থেকেই রীতাদেবীকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানায়, তাঁর মুখের বাঁ দিক থেঁতলানো ছিল। মাথা-সহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুরুতর আঘাত ছিল। স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা রীতাদেবীকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরে রাতেই থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করে মেজো দেওর টিঙ্কু ও তার স্ত্রী পুষ্পা। রীতাদেবীদের পাশের একটি বাড়িতে লুকিয়ে ছিল শাশুড়ি মীরাদেবী। সেখান থেকে রবিবার ভোরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। যে রড দিয়ে রীতাদেবীকে খুন করা হয়, সেটিও বাড়ি থেকেই উদ্ধার করেছে পুলিশ। রবিবার ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ কুকুরও।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, রীতাদেবীদের পাশের বাড়ির বাসিন্দা প্রতিমা ঘোষাল পুলিশকে জানান, শনিবার রাত আটটা নাগাদ তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। তার কিছুক্ষণ পর থেকেই রোজকার মতো পাশের বাড়িতে ঝগড়া শুরু হয়। প্রথমে প্রতিমাদেবী খুব একটা আমল দেননি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে রীতাদেবীর আর্তনাদ এবং তাঁর ছ’বছরের মেয়ের কান্না শুনে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে তিনি হকচকিয়ে যান। প্রতিমাদেবী বলেন, “সঞ্জীব একটি রড নিয়ে দোতলায় রীতাকে পরপর আঘাত করে যাচ্ছিল। ওই দৃশ্য দেখে আমি ছুটে ওদের বাড়িতে ঢুকতে যাই তাঁকে বাঁচাতে। কিন্তু সদর দরজায় শাশুড়ি দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিল।” প্রতিমাদেবী জানিয়েছেন, জোর করে ভিতরে ঢুকতে গেলে তাঁকে ঠেলে ফেলে দেয় রীতাদেবীর শাশুড়ি। পড়ে গিয়ে আঙুলে চোট পান তিনি। এর পরে প্রতিমাদেবীর চিৎকারে ছুটে আসেন অন্য বাসিন্দারা। তাঁরাই দরজা ঠেলে জোর-জবরদস্তি করে ওই বাড়ির ভিতরে ঢোকেন।


নিহত রীতা মণ্ডল। রবিবার।

এক বাসিন্দা সঞ্জয় ঘোষাল জানান, দোতলায় উঠতেই তাঁদের চোখে পড়ে রীতাদেবীর শরীরের অর্ধেক অংশ সিঁড়ি দিয়ে ঝুলছে। বাকি অর্ধেকটা সিঁড়ির উপরের মেঝেতে পড়ে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি। চারপাশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সঞ্জয়বাবু জানান, রীতাদেবীর মুখ দেখে চেনার উপায় ছিল না। মুখের বাঁ দিকে বড় বড় গর্ত হয়ে গিয়েছিল। রড দিয়ে তাঁর মুখে খুঁচিয়ে মারা হয়েছে বলে অভিযোগ।

রীতাদেবীর স্বামী রাজু মণ্ডল পেশায় ট্যাক্সিচালক। তাঁর একটি দোকানও রয়েছে। ঘটনার সময়ে তিনি বাড়ি ছিলেন না। রাজু জানান, দশ বছর ধরেই সম্পত্তি নিয়ে তাঁদের পরিবারে ঝামেলা চলছিল। মাস দুয়েক আগে রাজুুর বাবা মারা যান। তার আগে তিনি একটি জমি বিক্রি করেছিলেন। রাজুু জানিয়েছেন, সেই বিক্রি করা জমিতে প্রোমোটিং করা নিয়েও তাঁদের মধ্যে বিবাদ বাধে। রীতাদেবীরা চাইছিলেন, সম্পত্তি আগে ভাগ করতে হবে। সমান ভাগ পেলে তবেই ওই জমিতে তাঁরা প্রোমোটিং করতে দেবেন। রাজুুর অভিযোগ, তাঁর দুই ভাই তা চাইছিল না। তাঁর স্ত্রীকে খুনের পিছনে স্থানীয় এক দুষ্কৃতী ভাইদের মদত জুগিয়েছিল বলে অভিযোগে জানান রাজু। ওই দুষ্কৃতীর প্রোমোটিংয়ের ব্যবসা রয়েছে।

যদিও এই খুনের পিছনে স্থানীয় ওই দুষ্কৃতীর মদতের বিষয়টি মানতে চাননি পুলিশকর্তারা। কলকাতা পুলিশের বেহালা ডিভিশনের ডিসি রশিদ মুনির খান বলেন, “তিন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর এক জনের খোঁজ চলছে। ধৃতদের কেউই ওই দুষ্কৃতীর কথা জানায়নি। এমনকী, খুনের সময়ে ওই দুষ্কৃতী ঘটনাস্থলে উপস্থিতও ছিল না।”

ছবি: অরুণ লোধ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE