Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

মানসিক অসুস্থ বৃদ্ধাকে টিপ্পনী কাটলেন যাঁরা, তাঁদেরই পাশে দাঁড়াল পুলিশ!

এই ঘটনা দেখেই পুলিশের ভূমিকাকে ‘অমানবিক’ বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় গত ১৫ জানুয়ারির আনন্দবাজার পত্রিকায়।   কেন কোনও মহিলা পুলিশ কিংবা পাড়ার কোনও মহিলাকে ওই বৃদ্ধার সাহায্যে পাঠানো হল না, তা নিয়ে তোলা হয় প্রশ্ন।

এ ভাবেই বৃদ্ধার কথা মোবাইলে রেকর্ড করে কিছু যুবক। নিজস্ব চিত্র।

এ ভাবেই বৃদ্ধার কথা মোবাইলে রেকর্ড করে কিছু যুবক। নিজস্ব চিত্র।

দীক্ষা ভুঁইয়া
শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:৩১
Share: Save:

সদ্য স্বামী হারানো, মানসিক ভাবে অসুস্থ এক বৃদ্ধার সঙ্গে হাসিঠাট্টা করা একদল যুবকের পাশেই দাঁড়াল কলকাতা পুলিশ।

গত শনিবার গভীর রাতে হরিদেবপুরের ১২০৭/১ সি, উস্তাদ আমির খান সরণির একটি ফ্ল্যাট থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে শুনে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। দরজা ভেঙে উদ্ধার করে এক বৃদ্ধের আংশিক পচন ধরা মৃতদেহ। অমর সান্যাল নামে ওই বৃদ্ধের স্ত্রী হাসিরানিদেবী সে সময়ে মৃতদেহটি আগলে বসেছিলেন বলে দাবি পুলিশের। পুলিশের দাবি, চার দিন ধরে সে ভাবেই ছিলেন ওই মহিলা।

মৃতদেহ বার করে নিয়ে যাওয়ার পরে ফ্ল্যাটে একাই ছিলেন বৃদ্ধা। সুরক্ষায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল এক সাফাইকর্মীকে। পরে পুলিশ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা স্থানীয় ক্লাবের একদল যুবককে পাঠায় ওই বৃদ্ধাকে বোঝানোর জন্য! পরে সেই যুবকেরা ফ্ল্যাটে ঢুকে নিজেদের মোবাইলে শুধু বৃদ্ধার ছবিই তোলেননি, সঙ্গে তাঁকে উদ্দেশ্য করে টিপ্পনীও কাটতে থাকেন। নানা প্রশ্নে জর্জরিত বৃদ্ধা বারবার যুবকদের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। এর মধ্যেই এক জন বৃদ্ধাকে প্রশ্ন করেন, “দিদা, দাদু তো মরে গেল, তুমি একা এত বড় ফ্ল্যাট, টাকা নিয়ে কী করবে?”

এই ঘটনা দেখেই পুলিশের ভূমিকাকে ‘অমানবিক’ বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় গত ১৫ জানুয়ারির আনন্দবাজার পত্রিকায়। কেন কোনও মহিলা পুলিশ কিংবা পাড়ার কোনও মহিলাকে ওই বৃদ্ধার সাহায্যে পাঠানো হল না, তা নিয়ে তোলা হয় প্রশ্ন। গত মঙ্গলবার রাত ১১টা নাগাদ কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজে প্রতিবাদপত্র হিসেবে আনন্দবাজারের সম্পাদককে উদ্দেশ্য করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেই প্রতিবেদনে কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, শুধু ক্লাবের ছেলেরা নয়, স্থানীয় অন্য বাসিন্দারাও ছিলেন ঘটনাস্থলে। ছিলেন কয়েক জন মহিলাও। তা ছাড়া, সেখানে উপস্থিত পুলিশ অফিসারেরাও সে ধরনের কোনও কথাবার্তা শোনেননি বলেই দাবি করা হয়েছে তাতে।

কিন্তু ওই সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত কোনও বৈদ্যুতিন মাধ্যমের ক্যামেরা এবং আনন্দবাজারের চিত্র সংবাদিকের ক্যামেরায় কোনও মহিলার উপস্থিতিই ধরা পড়েনি। বৃদ্ধার ঘরে ঢুকে যাঁরা কথা বলছিলেন, তাঁরা সকলেই স্থানীয় ক্লাবের ছেলে। অর্থাৎ, যাঁদের বিরুদ্ধে বৃদ্ধাকে কটূক্তি করার অভিযোগ উঠেছে, পুলিশ তাঁদের বয়ান নিয়েই যে ফেসবুকের প্রতিবেদনটি লিখেছে, তা পরিষ্কার।

ফেসবুকে কলকাতা পুলিশের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ‘‘পুলিশ দেখে হাসিরানিদেবী খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। কিছুতেই ডাক্তারকে কাছেপিঠে আসতে দেবেন না। দেহ নিয়েও যেতে দেবেন না সৎকারের জন্য। এলাকার মানুষ ততক্ষণে জমা হয়েছেন বাড়িটির সামনে। এসেছে স্থানীয় ক্লাবের ছেলেরাও। পাড়ার সকলেই এই নিঃসন্তান দম্পতির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। জানতেন বৃদ্ধার মানসিক অবস্থার কথাও।’’

ফেসবুকের প্রতিবেদনে কলকাতা পুলিশই মন্তব্য করেছে, ‘‘দেহ ও ভাবে পড়ে থাকতে দেওয়া যায় না। হাসিরানিদেবীকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল পুলিশ, সঙ্গে যোগ দিলেন পাড়াপ্রতিবেশী এবং ক্লাবের ছেলেরা। বৃদ্ধা অসুস্থ, পুলিশকে দেখলেই রেগে যাচ্ছেন। পরিবারের লোকজনের ফোন নম্বর জোগাড় করে যোগাযোগ করা হল। কেউ দায়িত্ব নিলেন না। মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করেন, এমন দু’-একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গেও যোগাযোগ করা হল। যাঁরা জানালেন, অত রাতে লোক
পাঠানো মুশকিল, চেষ্টা করবেন পাঠাতে, তবে অনিশ্চিত।’’

প্রতিবেদনে পুলিশের আরও বক্তব্য, ‘‘এ অবস্থায় বৃদ্ধাকে বোঝানো ছাড়া উপায়ই বা কী আর? এ অবস্থায় স্থানীয় মানুষের, যাঁরা বৃদ্ধার পরিচিত, সাহায্য নেওয়া অন্যায়, ‘অমানবিক’?’’

কিন্তু পুলিশ যাকে সাহায্য বলছে, তাকে আসলে উত্ত্যক্ত করা বলেই মনে করছেন অনেকে। কী ভাবে মানসিক ভাবে অসুস্থ ওই বৃদ্ধাকে সহানুভূতি জানানোর বদলে উত্ত্যক্ত করা হয়েছে, তার সচিত্র প্রতিবেদন বৈদ্যুতিন মাধ্যমের ক্যামেরাবন্দিও হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ওই রাতে বৃদ্ধার সুরক্ষায় কোনও মহিলা পুলিশকর্মী ছিলেন না। ছিলেন না পাড়ার মহিলারাও। বৃদ্ধা বারবার করে যুবকদের ছবি তুলতে নিষেধ করছিলেন। কিন্তু উপস্থিত যুবকেরা প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করেছেন তাঁকে। এক সময়ে বৃদ্ধা এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে, তিনি যুবকদের তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেও বলেন। যুবকদের এই ব্যবহার মানবিক কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।

তবে কলকাতা পুলিশ কর্তৃপক্ষ বুধবার সেই প্রশ্নের কোনও ব্যাখ্যা দেননি। যুগ্ম কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকার বলেন, ‘‘ফেসবুকে আমরা যেটা লিখেছি, সেটাই
আমাদের সরকারি বক্তব্য। এর বেশি আমাদের কিছু বলার নেই।’’ যাঁরা বৃদ্ধাকে উত্ত্যক্ত করলেন, সেই যুবকদেরই কি পাশে দাঁড়াল না কলকাতা পুলিশ? সুপ্রতিমবাবুর একই জবাব, ‘‘ফেসবুকের লেখাটাই আমাদের বক্তব্য।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE