ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের এই বাড়িকেই হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছে। পটুয়াটোলা লেনে। —নিজস্ব চিত্র।
তাঁর বাড়ি হেরিটেজ! শুনে বিস্মিত অশীতিপর বৃদ্ধ। পাশে দাঁড়ানো স্ত্রী-ও ততোধিক বিস্মিত। সেই ১৯৯০ সালে শহর যখন হেরিটেজ-ধারণা নিয়ে হামাগুড়ি দিচ্ছে, সেই সময়েই পুরনো বাড়িটি ভেঙে নতুন করে তৈরি হয়ে গিয়েছে। তার পরেও শোভাবাজারের ৪৫বি নন্দরাম সেন স্ট্রিটের বাড়িটি কী করে হেরিটেজ হিসেবে ঘোষিত হল, কারাই বা তা করল, তা নিয়ে আতান্তরে পড়লেন বিমল বসাক নামে ওই বৃদ্ধ। কলকাতা পুরসভা তাঁর বাড়িকে হেরিটেজ ঘোষণা করেছে শুনে অসুস্থ বিমলবাবু বললেন, ‘‘কোথায়? পুরসভা তো আমাকে কিছু জানায়নি!’’
অথচ পুরসভার তথ্যই বলছে, ‘আর্কিটেকচারাল স্টাইল’ বা স্থাপত্যশৈলীর জন্যই নন্দরাম সেন স্ট্রিটের ওই বাড়িটি হেরিটেজ তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। তবে তা কোন গ্রেডের, এখনও সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি পুরসভা। তাই পুর তালিকায় ওই বাড়ি এখনও ‘গ্রেড পেন্ডিং’ হিসেবেই নথিভুক্ত।
২৩ নম্বর শোভাবাজার স্ট্রিটের প্রাণকৃষ্ণ কুণ্ডুও জানেন না, তাঁর বাড়ি হেরিটেজ হিসেবে ঘোষিত। সেই বাড়িরও গ্রেডেশন ঠিক করতে পারেননি পুর কর্তৃপক্ষ। তাই এ ক্ষেত্রেও ‘গ্রেড পেন্ডিং’! প্রাণকৃষ্ণবাবুরও এক প্রশ্ন, ‘‘পুরসভা তো আমাদের কিছু জানায়নি!
তা ছাড়া, বাড়ির মধ্যে তেমন তো কিছু নেই, যাতে হেরিটেজ ঘোষণা করা যায়।’’
এ দু’টি ঘটনা শহরের হেরিটেজ-বিভ্রান্তির বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন মাত্র! যে বিভ্রান্তি আজ, বুধবার বিশ্ব হেরিটেজ দিবসেও অব্যাহত! কোথাও বাড়ির মালিককে জানানোই হয়নি যে তাঁর বাড়ি হেরিটেজ! অথচ, নিয়মমতো যে মুহূর্তে কোনও বাড়ি হেরিটেজ হিসেবে ঘোষিত হবে, তখনই সংশ্লিষ্ট বাড়ির মালিককে চিঠি দিয়ে পুরসভার তা জানানোর কথা।
পুরসভার হেরিটেজ-তালিকা নিয়ে বিতর্কও হয়েছে একাধিক বার। গ্রেড পাল্টে পুরো ভবনই ভেঙে ফেলা হয়েছে, এমনও ঘটেছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হেরিটেজ-তালিকায় ‘গ্রেড পেন্ডিং’-এর সমস্যা। অতীতে যখন হেরিটেজ ভবনগুলির তালিকা প্রকাশ করেছিল পুরসভা, তখন শুধুমাত্র গ্রেড ওয়ান, গ্রেড টু এ এবং টু বি-র তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। সেটাও এক যুগ আগে। তখন বলা হয়েছিল, ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত, স্থাপত্যশৈলীর উৎকর্ষ-সহ একাধিক মাপকাঠি বিচার করে ঘোষিত হেরিটেজ ভবনগুলির গ্রেডেশন সম্পর্কিত তালিকা পরে প্রকাশ করা হবে। কিন্তু এখনও তা করা যায়নি!
এ দিকে, সমস্যায় পড়েছেন সংশ্লিষ্ট বাড়ির মালিকেরা। যেমন, ১২ নম্বর পটুয়াতলা লেনে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। ‘ডমরুচরিত’-এর লেখক ত্রৈলোক্যনাথ ভারতীয় জাদুঘরের প্রথম ভারতীয় কিউরেটরও ছিলেন। তাঁর পটুয়াতলা লেনের বাড়িকে হেরিটেজ ঘোষণা করলেও তার গ্রেডেশন কী হবে, ঠিক করতে পারেননি পুর কর্তৃপক্ষ। লেখকের পরিবারের তরফে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাড়ি ভেঙে পড়ছে। সারাতে পারছি না। হেরিটেজ মর্যাদা বাতিলের জন্য পুরসভায় আবেদনও করেছি।’’
হেরিটেজ-তালিকার ‘গ্রেড পেন্ডিং’-এর আরও একটি বিপদ রয়েছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের এক সদস্যের কথায়, ‘‘গ্রেডপ্রাপ্ত বাড়িকেই ভেঙে ফেলা হচ্ছে নির্বিচারে। সেখানে গ্রেডবিহীন বাড়ি ভাঙা তো আরও সহজ!’’ পুরসভার বর্তমান হেরিটেজ কমিটির সদস্য প্রণব চট্টোপাধ্যায়ের আবার অভিযোগ, ‘‘বাম আমলে যে হেরিটেজ-তালিকা তৈরি করা হয়েছিল, তাতে বিস্তর অসঙ্গতি।’’ কিন্তু তৃণমূল পুরবোর্ডের আমলেও কেন তালিকায় অসঙ্গতি? সদুত্তর মেলেনি। পুরসভার এক কর্তার কথায়, ‘‘কোনও ভবনের গ্রেডেশন ঠিক করার জন্য যে লোকবল বা পরিকাঠামো দরকার, তা পুরসভার নেই। ফলে সেগুলি আটকে রয়েছে।’’
কিন্তু সংশ্লিষ্ট বাড়ির মালিকেরা এত কিছু জানেন না। নন্দরাম সেন স্ট্রিটে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে বিমলবাবু বললেন, ‘‘আমি অসুস্থ। দেখবেন, এটা নিয়ে আবার সমস্যায় না পড়ি!’’
হেরিটেজ ঘোষণা যে আসলে মর্যাদা নয়, বরং সমস্যা, তা জানেন বিমলবাবুরা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy