মিলন: ছেলে এবং বাবার সঙ্গে সায়রা। বুধবার, পাভলভে। নিজস্ব চিত্র
একমুখ দাড়ি নিয়ে ছিপছিপে চেহারার ছেলেটাকে চিনতে পারেননি সায়রা। কিন্তু পাকা দাড়ি আর সাদা টুপি পরা ছোট চোখের মানুষটিকে ভুল করেননি তিনি। আব্বাজান! আর তার পরেই হাসিমুখে কখনও কান্না, কখনও আলিঙ্গন বাপ-বেটিতে। পাশে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে বছর কুড়ির ছেলেটি দু’চোখ ভরে দেখে নিচ্ছেন তাঁর মাকে।
কন্নড় ভাষায় কথা শুরু হতেই বড় ছেলে আসিফকে মাথায়-গালে হাত বুলিয়ে আদর শুরু! আব্বা আর ছেলের সঙ্গে সায়রা শুরু করলেন কত জমা গল্প। কিন্তু মাঝেমধ্যেই সে গল্পে ছেদ টানছিল সরকারি নিয়মের বেড়াজাল। উপায় নেই। ঘড়ির কাঁটায় তখন এগারোটা। হাতে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা। কারণ দীর্ঘ তেরো বছর পরে ঘরে ফিরতে ছেলে-বাবার সঙ্গে সাঁতরাগাছি থেকে ওই দিন অর্থাৎ বুধবারই দুপুর আড়াইটের ট্রেনে চেপেছেন সায়রা।
পাভলভের নথিতে সায়রার ইতিহাস বলছে, তেরো বছর আগে সুদূর কর্নাটকের বেলগাঁওয়ের মারিহাল গ্রামের চেনা পরিবেশ ছেড়েছিলেন মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত এই মেয়ে। তখন তাঁর বয়স বাইশ। তত দিনে তিন ছেলের মা, সায়রার জীবনে ঝড় বয়ে গিয়েছিল। স্বামী ফের বিয়ে করেন। পাশাপাশি চলেছিল শ্বশুর-শাশুড়ির অত্যাচার। মানসিক বিপর্যস্ত মেয়েকে তাই নিজের ঘরে ফিরিয়ে আনেন বাবা দস্তগির মোদিন বাগওয়ান। বাবা-মা, ভাইদের সঙ্গে তিন ছেলেকে নিয়ে থাকছিলেন সেখানেই।
এক দিন আত্মীয়ের বাড়ি থেকে একা ফেরার পথে চরম হেনস্থার শিকার হন সায়রা। ফের মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন। কাউকে না বলে ঘর ছাড়েন তিনি। তখন ছোট ছেলের বয়স চার। কেন, কোথায় যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিলেন সে সব আর মনে করতে পারেন না। ঘুরে ঘুরে হাজির হন এ শহরে। এরই মাঝে অসহায় সায়রাকে পথেঘাটে বারবার বিপদে পড়তে হয়েছে। উদভ্রান্তের মতো ঘুরতে দেখে বিষ্ণুপুর থানার পুলিশ তাঁকে দিয়ে যায় পাভলভে। সালটা ছিল ২০০৬।
এর পরে দীর্ঘ চিকিৎসা। বাড়ির কথা কিছুই মনে করতে পারতেন না তিনি। বাড়ি কোথায়? কর্নাটক। ব্যস ওই পর্যন্তই। প্রশিক্ষণের পরে গত আড়াই বছর ধরে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে তৈরি পাভলভেরই ধোবিঘরে কাজ করছিলেন সায়রা। মেয়েটির চরিত্রে এর পরেই পরিবর্তন লক্ষ করেন চিকিৎসক এবং কর্মীরা। ‘‘ধীরে ধীরে মিশুকে, সহনশীল, আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন সায়রা। ওঁদের এই কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্যই সম্ভব হয়েছে এই পরিবর্তন।’’ —বলছিলেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সিনিয়র প্রোজেক্ট ম্যানেজার শুক্লা দাস বড়ুয়া। সংস্থার তরফে রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘যত দিন রোগীর মানসিক পরিচর্যা, চিকিৎসা মানবিক না হয়ে উঠছে, তত দিন সায়রার মতো আরও অনেকে হাসপাতালের চার দেওয়ালেই আটকে থাকবেন।’’ মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেবের মতে, ‘‘সবার আগে মনোরোগীদের সঙ্গে আন্তরিক ভাবে মিশতে হবে। তবেই ওঁরা সহজ ভাবে মনের কথা বলতে পারবেন। যেমনটা হয়েছে পাভলভের সায়রার ক্ষেত্রে।’’
সায়রা বড় ছেলেকে শেষ দেখেছিলেন সাত বছর বয়সে। সেই আসিফ এখন আম ব্যবসায়ী। আরও দুই ছেলে আইটিআই পাশ করে কাজ খুঁজছেন। মা, ভাই, তাঁদের পরিবার এবং দুই ছেলে— এতগুলো মুখ আরও চল্লিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করে বসে থাকবে সায়রার জন্য। ঘরে ফিরে কাজ আর পরিবার নিয়ে মেতে ওঠা সায়রার খাতায় থাকবে আরও এক পরিবারের ঠিকানা। তাই সবার নম্বর নিয়েছেন। মাঝেমধ্যেই গল্প করতে হবে যে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy